ছাত্রলীগের ‘দাপুটে’ ১১ নেতারই ছাত্রত্ব নেই

  • সবাই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলের কক্ষ দখল করে অবৈধভাবে থাকছেন। চার নেতা খুন ও মারামারি মামলার আসামি।

  • বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি পক্ষে বিভক্ত।

  • একটি পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী।

  • আরেকটি পক্ষ সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই সদস্যের কমিটি ঘোষিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। কমিটিতে সভাপতি হন রেজাউল হক ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন। রেজাউল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৬ বছর আগে। আর ইকবাল ভর্তি হন ১১ বছর আগে। তাঁদের কারও ছাত্রত্ব নেই। তারপরও ক্যাম্পাসে তাঁদেরই ‘দাপট’।

শুধু এই দুই নেতা নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা আরও ৯ নেতারও ছাত্রত্ব নেই। এর মধ্যে চারজন নেতা খুন ও মারামারি মামলার আসামি। রয়েছে চাঁদাবাজি ও শিক্ষককে মারধরের হুমকির অভিযোগও। নেতারা সবাই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলের কক্ষ দখল করে অবৈধভাবে থাকছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারও বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি পক্ষে বিভক্ত। তাদের একটি পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরীর এবং আরেকটি পক্ষ সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতারা এখন সংগঠনের আড়ালে একধরনের ব্যবসা করছেন। নেতা নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় কমিটিকে আরও সচেতন ও স্বচ্ছ হতে হবে।
মফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ, চট্টগ্রাম

আবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিও দুই সদস্যের মধ্যে সভাপতি রেজাউল হক মহিবুল হাসানের এবং সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন আ জ ম নাছিরের অনুসারী। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে রয়েছে ১১টি উপপক্ষও। এর মধ্যে বিজয় ও চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি) মহিবুলের, বাকি ৯টি উপপক্ষ—ভার্সিটি এক্সপ্রেস, কনকর্ড, বাংলার মুখ, সিক্সটি নাইন, একাকার, রেড সিগন্যাল, উল্কা, এপিটাফ ও স্বাধীনতা আ জ ম নাছিরের অনুসারীদের।

ছাত্রলীগ ও পুলিশ সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের দুই সদস্যের কমিটি হওয়ার পর এসব উপপক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অন্তত ৩৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষের পেছনে ছিল হলের আসন দখল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চাঁদার ভাগ–বাঁটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার এবং ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।

শুধু রাজু মুন্সী নন, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের প্রদীপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধেও রয়েছে খুনের মামলা। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের সামনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার খুন হন। এ মামলায় প্রদীপ চক্রবর্তীও আসামি। এ ছাড়া সিএফসির নেতা নাছির উদ্দিন ও বাংলার মুখের আবু বকর নিজের সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলার মামলার আসামি। আবু বকরের দাবি, তিনি মামলায় জেল খাটলেও পরে খালাস পান।

নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েই শুধু থামছেন না নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন ও হেনস্তাও করছেন। সর্বশেষ ১৭ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন ছাত্রলীগের দুই কর্মীসহ ছয়জন। প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে তাঁদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ওই দুই কর্মীর একজন সভাপতি রেজাউল হকের ও অপরজন ভার্সিটি এক্সপ্রেসের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তীর অনুসারী। এ ছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই ছাত্রীকে হেনস্তার দায়ে গতকাল সোমবার এক বছরের জন্য বহিষ্কৃত চার ছাত্রলীগ কর্মীও রেজাউলের অনুসারী।

নেতারা কে কখন ভর্তি হন

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হন ১৬ বছর আগে, ২০০৬-২০০৭ শিক্ষাবর্ষে। তিনি স্নাতক পাস করেন ২০১০ সালে। স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ২০১৩ সালে। কিন্তু রেজাউল হক এখনো ক্যাম্পাস রাজনীতিতে যুক্ত। রেজাউল হকের দাবি, তিনি জাপানি ভাষা কোর্সে ভর্তি আছেন।

ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন ১১ বছর আগে, ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে। তিনি স্নাতক পাস করেছেন ২০১৬ সালে। তিনি আর স্নাতকোত্তরও করেননি।

নেতাদের ছাত্রত্ব না থাকা নিয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিন বছর আগে কমিটি ঘোষণার সময় রেজাউল ও ইকবালের ছাত্রত্ব আছে বলে জেনেছেন তাঁরা। এখন নতুন কমিটি হলে কোনো অছাত্র পদ পাবে না।

এ ছাড়া সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি নাছির উদ্দিন ১২ বছর আগে, সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল হাসান, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ ১১ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

এদিকে সাবেক সদস্য সায়েদুল ইসলাম, সিক্সটি নাইনের নেতা রাজু মুন্সী ও শামসুজ্জামান সম্রাট, একাকার উপপক্ষের মঈনুল ইসলাম এবং বাংলার মুখের নেতা ও সাবেক পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর ভর্তি হন ১০ বছর আগে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, ছয় শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতক ও দুই শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতকোত্তর পাস করতে হবে। আইন অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীদের কারও ছাত্র নেই বলছেন শিক্ষকেরা।

ছাত্রত্ব না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে সাবেক পাঠাগার সম্পাদক আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, নেতাদের কারও ছাত্রত্ব নেই। তারপরও ক্যাম্পাসে পড়ে থাকতে হচ্ছে। এখানে একাডেমিক জটের চেয়ে ছাত্রলীগের কমিটির জট বেশি। গঠনতন্ত্র মেনে নিয়মিত কমিটি হয় না।

পাস করেও হলে থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আসন বরাদ্দ বন্ধ থাকায় নেতারা হলে থাকছেন। বরাদ্দ দিলে তাঁরা বের হয়ে যাবেন।

তবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অবৈধভাবে হলে থাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, খুনের মামলা কিংবা চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে এমন কেউ হলে থাকছেন কি না, তা তাঁর জানা নেই। অছাত্র কেউ হলে থাকছেন, এমন তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেবেন।

খুন, মারামারির মামলার আসামি

চট্টগ্রাম রেলওয়ের কোটি টাকার দরপত্রের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ২০১৩ সালের ২৪ জুন যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিতে প্রাণ হারান যুবলীগের কর্মী সাজু পালিতসহ দুজন। সে মামলার আসামি সিক্সটি নাইনের নেতা রাজু মুন্সি। ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে শিক্ষককে মারধরের হুমকি—সবখানেই রাজু মুন্সীর নাম রয়েছে।

গত ৪ এপ্রিল নাট্যকলা বিভাগের এক শিক্ষককে ফোন করে মারধরের হুমকি দেন রাজু মুন্সী। এক ছাত্রলীগ কর্মীর নকল ধরায় ওই শিক্ষককে তিনি মারধরের হুমকি দিয়েছিলেন। এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজু মুন্সীসহ আরও কয়েকজন নেতা-কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের নির্মাণাধীন একটি ভবনে গিয়ে ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবি করেন। ওই ঠিকাদার কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন।

শুধু রাজু মুন্সী নন, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের প্রদীপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধেও রয়েছে খুনের মামলা। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের সামনে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার খুন হন। এ মামলায় প্রদীপ চক্রবর্তীও আসামি। এ ছাড়া সিএফসির নেতা নাছির উদ্দিন ও বাংলার মুখের আবু বকর নিজের সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলার মামলার আসামি। আবু বকরের দাবি, তিনি মামলায় জেল খাটলেও পরে খালাস পান।

ছাত্রী নিপীড়ন থেকে শুরু করে খুনের মামলায় ছাত্রলীগের নাম জড়ানোয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। তিনি আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতারা এখন সংগঠনের আড়ালে একধরনের ব্যবসা করছেন। নেতা নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় কমিটিকে আরও সচেতন ও স্বচ্ছ হতে হবে।