বামপন্থী আট ছাত্রসংগঠনের নতুন জোট গঠন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে আজ বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন জোট গঠনের ঘোষণা দেন বামপন্থী আটটি ছাত্রসংগঠনের নেতারা
ছবি: সংগৃহীত

গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট নামে নতুন একটি জোট গঠন করেছে বামধারার আটটি ছাত্রসংগঠন। আজ বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন জোটের ঘোষণা দেন সংগঠনগুলোর নেতারা।

এই জোটে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের (নজির-রাগীব) নেতারা রয়েছেন। এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল), বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন এবং বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রয়েছে। তবে ছাত্র ইউনিয়ন (ফয়েজ-দীপক) ও ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি আন্দোলন) জোটে নেই।

গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী। জোটের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে দুপুরে মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে লিখিত বক্তব্যে সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা একদলীয় ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনে জনজীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ আর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। আওয়ামী উন্নয়নের স্লোগান পরিণত হয়েছে ফাঁপা বুলিতে। শাসকশ্রেণি খুব কৌশলের সঙ্গে পাঠ্যসূচিতে ইতিহাস বিকৃতি ও প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান যুক্ত করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পাহাড় কিংবা সমতলে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমির অধিকার কিংবা সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-কৃষ্টি সংরক্ষণের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’

অভিযোগ করা হয়, পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে সংঘাত বাধিয়ে বিভক্ত করে তাদের শোষণ ও শাসন চলছে। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে। কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, দিন দিন সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। মেগা প্রকল্পের আড়ালে মেগা দুর্নীতির সমারোহ চলছে। ঋণখেলাপিদের কোটি কোটি টাকার ঋণ মওকুফ, দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া খুব সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

ঘরে কিংবা বাইরে নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের মাত্রা ভয়ংকরভাবে বেড়েই চলেছে। এই রাষ্ট্র নারীর জন্য কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি বরং প্রণয়ন করেছে নারী স্বার্থবিরোধী নানা আইন। এ রকম পরিস্থিতি থেকে ছাত্রসমাজসহ আপামর জনগণ মুক্তি চাইছে।

এ সময় জোটের ১৩ দফা দাবিও ঘোষণা করেন সালমান সিদ্দিকী। তাঁদের দাবির মধ্যে রয়েছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ; সর্বজনীন-বৈষম্যহীন-বিজ্ঞানভিত্তিক-গণতান্ত্রিক একই ধারার শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারীকরণ-সাম্প্রদায়িকীকরণ-সংকোচন নীতি বাতিল এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০ বাতিল; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে আবাসিক হলে আসনবণ্টন, গণরুম-গেস্টরুম বন্ধ করা ও ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া; বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা, বরেণ্য-সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে আচার্য হিসেবে নিয়োগ ও ইউজিসির কৌশলপত্র-হেকেপ-পিপিপিসহ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে চালু করা সব শিক্ষাবিধ্বংসী প্রকল্প বাতিল; বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আরোপ না করা, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি কমানো এবং অভিন্ন নীতিমালা ও বেতন কাঠামো নির্ধারণ; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষ ও স্বতন্ত্র পরীক্ষা হল নির্মাণ করে নিয়মিত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা; শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা এবং পাঠ্যসূচি থেকে ইতিহাস বিকৃতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক উপাদান বাতিল।

এসব দাবিতে আগামী ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্র সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
‘ছাত্রদলকে না’

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর দুটি জোট ছিল প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য। আমরা জোটগতভাবে এবং একসঙ্গে নানা কর্মসূচি করেছি। বর্তমানে সারা দেশে যে ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। সেই লক্ষ্যে সুস্পষ্ট কিছু দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আমরা একসঙ্গে গণতান্ত্রির ছাত্রজোট গঠন করলাম। আমরা মনে করি, এর বাইরেও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আমাদের আলাপ হতে পারে। যেসব গণতান্ত্রিক শক্তি মনে করে যে চলমান ফ্যাসিবাদকে রুখে দেওয়া দরকার, তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা দুর্বার আন্দোলন করতে চাই।’

ছাত্র ইউনিয়ন (ফয়েজ-দীপক) ও ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি) কেন গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটে নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা আমাদের ১৩ দফা দাবি ও ঘোষণাপত্রের সঙ্গে একমত পোষণ করবে, তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করতে প্রস্তুত। তবে কোনো কোনো সংগঠনের সঙ্গে আমরা এ ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। কিন্তু আলোচনার পথটা খোলা আছে এবং আলোচনা চলছে। আমাদের ধারণা, শিগগিরই আমরা একসঙ্গে হতে পারব।’

বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিষয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন ছাত্রদল আজকের ছাত্রলীগের মতোই ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাস-দখলদারি ও নির্যাতন-নিপীড়নের রাজনীতি করেছে। সামনের দিনে ক্ষমতায় গেলে তারা একই কাজ করবে বলে আমরা মনে করি। তাদের সরকার বিরোধিতার মধ্যে কোনো গণতান্ত্রিক চেতনা নেই, কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই৷ ফলে আমরা স্পষ্টভাবেই মনে করি, ছাত্রদল আজকের ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ হতে পারে না৷ আমাদের গণতান্ত্রিক দাবিগুলোর বিষয়ে তাদের অবস্থান ও রাজনীতি সংগতিপূর্ণ নয়। আমাদের জোটের ১৩ দফা দাবি ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আমরা কাজ করব।’

এ সময় অন্যদের মধ্যে ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ, ছাত্র ফেডারেশনের (মুক্তি কাউন্সিল) সভাপতি মিতু সরকার, ছাত্র ইউনিয়নের (নজির-রাগীব) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী, ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।