রাজনৈতিক সংকট কি চলতেই থাকবে

অন্য দিনের সূর্যোদয়ের সঙ্গে বছরের প্রথম দিনটির সূর্যোদয়ের কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু মানুষ অতীতের হতাশা-ব্যর্থতা ভুলে নতুন বছরে নতুন আশা দেখে। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বোনে।

নতুন বছরের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের পুরোনো বছরের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল ঘটন-অঘটন-উত্তেজনায় পূর্ণ, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনড় অবস্থান সত্ত্বেও জনমনে আশা ছিল, একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়তো বেরিয়ে আসবে; কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি।

২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা, গণগ্রেপ্তার এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অবাধ, সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব আশা শেষ করে দেয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেউ কারও অবস্থান থেকে সরে আসতে রাজি হয়নি। বিদেশি কূটনীতিকদের ঘন ঘন বৈঠক, পরামর্শ এবং বহুল আলোচিত মার্কিন ভিসা নীতিও সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

ফলে ৭ জানুয়ারি আমরা ভিন্ন আদলে ২০১৪-এর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাব। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৮টি দল এ নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপিসহ ১৫টি দল নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি নির্বাচনবিরোধী প্রচার ও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। ক্ষমতাসীনেরা চাইছেন ভোটকেন্দ্রে বেশিসংখ্যক ভোটার আসুক, বিরোধী দল চাইছে একতরফা নির্বাচন তারা বর্জন করুক। দুই দলের কর্মী-সমর্থকেরা যার যার অবস্থানে অটল। কিন্তু দলীয় বৃত্তের বাইরের মানুষগুলো কোথায় যাবে?

বিএনপিহীন নির্বাচনটির রূপ কেমন হবে? ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর, আগুন দেওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটছে। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের কড়া নির্দেশ কিংবা নির্বাচন কমিশনের হম্বিতম্বিও নির্বাচনী সংঘাত কমাতে পারেনি।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস খুব সুখকর নয়। এর আগের ১১টি নির্বাচনের মধ্যে ৩টি নির্বাচন হয়েছে একতরফা, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া—১৯৮৮, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ২০১৪।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি যেভাবেই হোক না কেন, এর ভিত্তিতে নতুন সংসদ গঠিত হবে। নতুন সরকার হবে। কিন্তু সেই নতুন সরকার ও সংসদ রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে পারবে, না সংঘাত চলতে থাকবে—সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়েও দলগুলোর অবস্থান বিপরীতধর্মী। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমাদের দায়িত্ব হবে, গত ১৫ বছরের উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করা এবং নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসা।’ রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু যারা সাংবিধানিক সরকারকে হটাতে চাইবে, তাদের সঙ্গে তো কোনো সমঝোতা হতে পারে না।’

নির্বাচন-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গেও কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন হবে, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ তিনি ভোটের আগে কঠোর কর্মসূচিরও ইঙ্গিত দিলেন। নির্বাচনের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সমঝোতার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, সমঝোতার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।

একতরফা কিংবা অংশগ্রহণমূলক হোক, প্রতিটি নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো ইশতেহার ঘোষণা করে, যা জনগণের প্রতি তাদের অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচিত হয়। ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার কথা বলা হয়েছে। তারা ‘অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার’ পাশাপাশি সাংবাদিকেরা যাতে নির্যাতন, ভয়ভীতি, হুমকি, মিথ্যা মামলার সম্মুখীন না হন, তার ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশবাসী আশা করে, এটা নিছক কথার কথা হবে না।

উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ ক্রমেই নিম্নগামী ছিল। পশ্চিমের উন্নত দেশের তুলনায় তো বটেই, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যেও সবার নিচে।

আশাভঙ্গের ২০২৩ পেরিয়ে বাংলাদেশ ২০২৪-এ কোনো আশা জাগাতে পারবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। তাঁরা যদি দেশের সার্বিক অগ্রগতি চান, যদি ১৭ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার ও কল্যাণের কথা ভাবেন, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব দলের দায় থাকলেও মূল উদ্যোগটা আসতে হবে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকেই।

নতুন বছরের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত আমরা একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারব, তত দিন পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক সংকট চলতেই থাকবে।’ সেই সঙ্গে তিনি আরও যোগ করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল ও অকেজো হলে অগণতান্ত্রিক ও চরমপন্থী শক্তির উত্থানের আশঙ্কা বেড়ে যায়।