লুটপাটের সুবিধার্থে বিদ্যুৎ খাতকে বেছে নেওয়া হয়েছে: মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘দেশের জ্বালানি খাতে অমানিশা: লুটপাট আর অরাজকতার চালচিত্র’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন। ঢাকা, ২২ মে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, লুটপাটের সুবিধার্থে বিদ্যুৎ খাতকে বেছে নেওয়া হয়েছে। রেন্টাল–কুইক রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র) আর ক্যাপাসিটি চার্জ (সক্ষমতার ভাড়া) দিয়ে বাজে অবস্থা করেছে। কয়েকটা কোম্পানি সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত, সিংহভাগ তারাই নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের পকেটের টাকা লুট করে বিদেশে বিনিয়োগ করছে তারা।

রাজধানীর একটি হোটেলে ‘দেশের জ্বালানি খাতে অমানিশা: লুটপাট আর অরাজকতার চালচিত্র’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। আজ সোমবার বিএনপি সমর্থক প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (অ্যাব) এই আলোচনার আয়োজন করে।

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ লুটপাটতন্ত্র কায়েম করেছে। অর্থনীতি অতি দ্রুত রসাতলে যাচ্ছে। একটা উন্নয়নবিভ্রম সৃষ্টি করেছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, গোটা রাষ্ট্রকে পরিকল্পিতভাবে পরনির্ভরশীল ও রাজনৈতিকভাবে কুক্ষিগত করে রাখাই সরকারের লক্ষ্য। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দিতে দিতে বাজে অবস্থা হয়েছে। ঋণের বোঝা বাড়ছে। ভবিষ্যতে এ বোঝা বহন করতে পারবে বলে কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন না। সরকার পরিবর্তন না হলে চুরি, দুর্নীতি বন্ধ হবে না। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হবে। লুটপাটের অর্থনীতি, মাফিয়া অর্থনীতি বন্ধে সরকার পরিবর্তন করতে হবে। এর জন্য জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন পুনরায় শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ হামলা শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় সরকারি দলের গুন্ডারা হামলা করেছে। সভা পণ্ড করে দিয়েছে। সন্ত্রাস দিয়ে, পুলিশ ব্যবহার করে জনগণের আন্দোলন তছনছ করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ মানেই সন্ত্রাসী, আওয়ামী লীগ মানেই দুর্নীতিবাজ। দলটির রসায়ন থেকে এ দুটো বের হয়ে আসে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে আসার কথা বলা হচ্ছে। অথচ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে। ৪০ লাখ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। বিশ্বে এমন নজির কোথাও নেই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অসম্ভব। ১৯৯৬ সালে এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বারবার বলেছেন। এখন ঘুরে গেছেন। তিনি আরও বলেন, ন্যাড়া বারবার বেলতলায় যায় না। দিনের ভোট রাতে করার, ভোট চুরির এমন নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ আর পা দেবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।

গোলটেবিল আলোচনার শুরুতে ‘দেশের জ্বালানি খাতে অমানিশা: লুটপাট আর অরাজকতার চালচিত্র’ শিরোনামে নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের মহাসচিব হাছিন আহমেদ। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ খাতে গত দেড় দশকে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ আর একই সময়ে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে মাত্র ১৭৬ শতাংশ। বসিয়ে বসিয়ে কেন্দ্র ভাড়া দিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এমন বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের মতো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তরের টার্মিনালেও ক্যাপাসিটি চার্জ (সক্ষমতার ভাড়া) দিতে হয়। দুটি টার্মিনালের ভাড়া দিনে পাঁচ কোটি টাকা। আরও দুটি টার্মিনালের কাজ দেওয়া হয়েছে।

নিবন্ধে বলা হয়, দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা অনেক, অনুসন্ধানের বিপরীতে গ্যাসপ্রাপ্তিতে অন্য দেশের চেয়ে সাফল্যও বেশি। অথচ সরকার আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। নিজেদের সম্পদ মাটির নিচে রেখে পরনির্ভর জ্বালানি নীতি নিয়েছে সরকার। ভোলার গ্যাস কাজে লাগানো হয়নি। এখন দরপত্র ছাড়া একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিয়ে ভোলার গ্যাস সিএনজি করে বাইরে আনার কাজ দেওয়া হয়েছে। অথচ ভোলা ও আশপাশের জেলার মধ্যে পাইপলাইন করা হলে সেখানে শিল্প বিনিয়োগ হতো, উন্নয়ন হতো। ঢাকার গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস অনিয়ম করছে উল্লেখ করে বলা হয়, তিতাসের প্রিপেইড মিটার গ্রাহকেরা মাসে যে বিল দেয়, তার তিন গুণ দিতে হয় মিটার ছাড়া গ্রাহকদের।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আছে। এসব খনিতে থাকা কয়লার গুণগত মান বিশ্বের অনেক দেশের কয়লার চেয়ে ভালো। এসব কয়লা না তুলে আমদানি করা হচ্ছে। ডলারের অভাবে এখন আমদানি করতে পারছে না। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে, লোডশেডিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের বড় গোষ্ঠীকে দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দেওয়া হয়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হবে ১৬ টাকার বেশি দামে। পৃথিবীর কোথাও এমন দামে সৌরবিদ্যুৎ কেনার নজির নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে এটি পাঁচ গুণ। এ কোম্পানি বন্ড ছেড়ে বেসরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে টানা নিয়েছে। এভাবে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ–উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি আইন করার সময়ই বোঝা গিয়েছিল, তারা দুর্নীতির মহাসড়কে নিয়ে যাবে। দেশ এখন ধীরে ধীরে তলাবিহীন ঝুড়ির দিকে যাচ্ছে।

গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন অ্যাব সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আগে ছিল একটি, এখন দুটি প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এটি করা হয়েছে। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লুৎফুর রহমান, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান সেলিম ভূঁইয়া প্রমুখ।