‘অবাধ্য’ নেতাদের সামলাতে আওয়ামী লীগ–বিএনপি হাঁটছে একই পথে

  • দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদ সদস্যদের ৫০ স্বজন এখনো প্রার্থী।

  • শাস্তি দিলেই তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা দূর হবে, এ নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

  • ভোটে নেতাদের ঠেকাতে বিএনপির চেষ্টা ব্যর্থ।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে একধরনের অস্বস্তিতে পড়েছে। দুটি দলেরই যে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন ঘিরে তা দৃশ্যমান হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দীর্ঘ মেয়াদে দুটি দলকেই এর রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। যদিও ‘অবাধ্য’ নেতাদের সামলাতে দুই দলই শাস্তি দেওয়ার পথে হাঁটছে। এই পথ দলে কতটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের জন্য পরিস্থিতিটা বেশ জটিল বলা যায়। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়েছে যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে এর প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। দলের নেতৃত্ব দফায় দফায় নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের, তাঁরা যেন উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করেন। কিন্তু ভিন্ন চিত্র দাঁড়িয়েছে মাঠে।

দলের নির্দেশ ও শাস্তির হুমকি উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের অন্তত ৫০ জনের মতো সন্তান, ভাই, শ্যালকসহ নিকট আত্মীয় প্রার্থী হয়েছেন। সংসদ সদস্যদের অনেকে আবার নিজের পছন্দের নেতাকে প্রার্থী করেছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে অস্বস্তি। শাস্তির পথ কতটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে, সেই প্রশ্ন রয়েছে।

ব্যর্থ হয় চেষ্টা

মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। শুধু নাটোরে একজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। সেখানে আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনা বড় বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। সেই ঘটনায় অভিযোগ ওঠে লুৎফুল হাবীবের বিরুদ্ধে, যিনি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের শ্যালক। ঘটনাটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে আওয়ামী লীগকে। ফলে লুৎফুল হাবীব ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এ ছাড়া আর কোনো সংসদ সদস্যের স্বজন ভোট থেকে সরে দাঁড়াননি।

এদিকে ২৪ এপ্রিল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার প্রশ্নে প্রকাশ্যে বিতর্কে জড়ান সংসদ সদস্য শাজাহান খান ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শাজাহান খান তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেছেন মাদারীপুর সদর উপজেলায়। একই উপজেলায় তাঁর ভাই পাভেলুর রহমান খানও প্রার্থী হয়েছেন। এরপরও শাজাহান খানের ছেলে প্রার্থী রয়ে গেছেন।

বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা কিছু উপজেলায় প্রার্থী রয়েছেন। কিন্তু বেশির ভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও শঙ্কা প্রকাশ করেছে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ নিয়ে। দলীয় শৃঙ্খলা যে ভেঙে পড়েছে, তা স্বীকার করছেন দলটির নীতিনির্ধারকদেরও কেউ কেউ।

আরও পড়ুন

শাস্তিই কি সমাধান

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার এই নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তনের কোনো বিষয় নেই। রাজনৈতিকভাবেও ভোট হচ্ছে না; আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক দেয়নি। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল দলের তৃণমূলের বিভেদ দূর করা। বিএনপির বর্জনের মুখে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ার আওয়ামী লীগের কৌশলে তৃণমূলে বিভেদ সৃষ্টি হয়। সেই বিভেদ নিরসনে দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচন না করার কৌশলও ব্যর্থ হতে পারে। দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দলের তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বা কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কতটা কঠোর হতে পারবে দলটি, সেই প্রশ্ন আছে। আর শাস্তি দিলেই তৃণমূলে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা দূর হবে, এটা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান জাতীয় সংসদেই ১৫টি পরিবারকেন্দ্রিক সংসদ সদস্য রয়েছেন। সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের স্বজনকে ঠেকানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন। দলটি যে পদক্ষেপই নিক না কেন, দলের তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে বলেই মনে করেন তিনি।

লক্ষ্যহীন বিএনপি

গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করছে বিএনপি। তবে দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে যাঁরা ভোটের মাঠে নেমেছেন, তাঁদের ঠেকাতে বিএনপি নেতৃত্বের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম দফায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৫ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। চার দফায় উপজেলা নির্বাচনে এই বহিষ্কারের তালিকা আরও দীর্ঘ হবে।

আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি কীভাবে এগোবে, সেই লক্ষ্য ঠিক করতে পারছে না। দলের লক্ষ্যহীন এ অবস্থা দেখা গেছে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ মুহূর্তে গিয়ে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর মধ্যেই দলটির অনেক নেতা ভোটে নেমে পড়েন।

তৃণমূলের বাস্তবতা আসলে কতটা বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপির নেতৃত্ব, সেই আলোচনাও রয়েছে দলটিতে। কারণ, দীর্ঘ আন্দোলনে মামলায় জর্জরিত দলের নেতা-কর্মীদের এখন আদালতে যাতায়াত দৈনন্দিন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মামলা লড়তে অর্থের জোগানের বিষয় তো আছেই। একদিকে মামলার বোঝা, অন্যদিকে আন্দোলনে ব্যর্থতার হতাশা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। কিন্তু জনসমর্থন আছে, মাঠের এমন নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় ঘুরে দাঁড়ানোর বা একটা অবস্থান তৈরির একটা সুযোগ এসেছিল উপজেলা নির্বাচনে।

বিএনপি ২০২১ সাল থেকে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকারের কোনো কাঠামোতেই দলগত অবস্থান নেই ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির। তৃণমূলে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতার ক্ষেত্রে এরও একটা প্রভাব রয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এই সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়। পরিস্থিতিটাকে দলের নেতাদের কেউ কেউ স্বীকার করেন। তবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলীয় নেতাদের বহিষ্কারের তালিকা দীর্ঘ হলে সেটি তৃণমূলের সংগঠনকে আরও দুর্বল করবে। এমন পর্যালোচনা বিএনপির ভেতরেও আছে। এরপরও কঠোর অবস্থানেই রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, উপজেলা নির্বাচনে যে অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, তাতে দুই দলকেই দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে।