মাহফুজ-সারজিসরা নন, গণ–অভ্যুত্থানের প্রকৃত নায়ক ছিলেন সাধারণ মানুষ: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের প্রকৃত নায়ক মাহফুজ–সারজিসরা নন, প্রকৃত নায়ক দেশের সাধারণ মানুষেরা, যাঁরা জীবনের মায়া ছেড়ে বুলেটের মুখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘মাহফুজ সারজিসরা গণ–অভ্যুত্থানের নায়ক নন। গণ–অভ্যুত্থানের নায়ক হলেন হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের অন্যান্য সময়ের মতো যাঁরা নায়ক, তাঁদের বঞ্চিত করে একটা অংশ। তাঁদেরও ভূমিকা ছিল, আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাঁরা সেটাকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছেন।’
সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে আয়োজিত এক স্মরণসভায় এ কথা বলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
আন্দোলনের নায়ক দাবি করা পক্ষটি ৫ আগস্টের পর আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, ‘তাঁরা বলেছেন, “আর রাজনৈতিক দলগুলোকে তো পাইনি।” কিন্তু ১৬ বছর ধরে যে সংগ্রাম চলল, সেই সংগ্রামের ফসল এবং চূড়ান্তভাবে জনগণের ভূমিকার ভেতর দিয়ে কিন্তু এই গণ–অভ্যুত্থান তাঁর সফলতা অর্জন করেছিল।’
মোহাম্মদ ফরহাদ প্রসঙ্গে সিপিবির এই নেতা বলেন, দেশের যেকোনো সংকটে মোহাম্মদ ফরহাদ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তাঁর জীবদ্দশায় সংবিধান, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে সৃষ্টি হওয়া যেকোনো জটিল পরিস্থিতিতে তিনি পথ দেখাতে পারতেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সাংবিধানিক বিষয়াবলি নিয়ে গণভোট শুধু অপ্রয়োজনীয়, তা–ই নয়, এর তেমন কোনো আইনগত গুরুত্ব নেই। তিনি মনে করেন, ঐকমত্য না হওয়া বিষয়ে জনমত যাচাইয়ের এখতিয়ার সরকারের নেই। বরং নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই এই সরকারের দায়িত্ব।
বৈষম্যহীন সমাজের কথা বললেও চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পরে দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও নারীদের নতুন করে বৈষম্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম।
ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, ‘হাসিনাবিরোধী আন্দোলন ছিল, তাঁকে উৎখাতের প্রয়োজন ছিল, সবই ঠিক আছে। সেই আন্দোলনে আমরাও আপনাদের সঙ্গে আছি, একমত। কিন্তু আমি একটা জায়গায় দেখি, এই যে জুলাই আন্দোলন আপনারা এটাকে বলছেন, সেই আন্দোলনের মূল কেন্দ্রটা কী, আপনারা ভেবে দেখেছেন কি না। আমি একজন মহিলা সংগঠক হিসেবে দেখি, আন্দোলনের ভিত্তিটা দাঁড়িয়েছে, একটা বৈষম্যহীনের কথা বলে একটা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য তাঁরা আন্দোলনটা শুরু করেছেন। সেই বৈষম্য তাঁরা কোথায় সৃষ্টি করেছেন? মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বৈষম্য, নারী জাতির সঙ্গে বৈষম্য।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল উল্লেখ করে ফৌজিয়া মোসলেম বলেন, এর নেপথ্যে ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।
মোহাম্মদ ফরহাদ আকণ্ঠ বিপ্লবপিয়াসী ছিলেন বলে উল্লেখ করেন সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সিপিবি দেশের সচেতন মহলের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাতে পেরেছে যে দল হিসেবে দেশের যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই করে যাবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি উল্লেখ করে রুহিন হোসেন বলেন, ‘বরং সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ, ভিন্নমত দমন ইত্যাদি গণবিরোধী কাজের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে তারা ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারায় পরিচালনা করেছে।’
স্মরণসভায় মোহাম্মদ ফরহাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন। তিনি বলেন, ‘একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার সংগ্রামে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ তাঁর গোটা জীবন ব্যয় করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান পর্বে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর দেখানো সেই সংগ্রামের পথ ধরেই সিপিবি অগ্রসর হচ্ছে।’
সিপিবির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জলি তালুকদারের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দিবালোক সিংহসহ কয়েকজন নেতা বক্তব্য দেন।
সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, বামপন্থী নেতা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন প্রয়াত এই বামপন্থী নেতা। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।