অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিয়ে নতুন বিতর্ক

চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য ঘিরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের বিষয়টি সামনে এসেছে
ছবি: চীন দূতাবাস

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রশ্ন নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এবার এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে বাংলাদেশের যে অবস্থান, চীন তা সমর্থন করে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ আছে কি না?

দেশের অনেক রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে এবং বিশেষ করে নির্বাচনের আগে।

বিশ্লেষকদের অনেকে আবার নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাকে হস্তক্ষেপ বলতে রাজি নন। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকায় তা মেটাতে বিদেশি কূটনীতিকেরা একধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করেন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—প্রধান দুই দলই বলছে, বিদেশি হস্তক্ষেপ নেই।

বিদেশিরা সুযোগ পাচ্ছেন কেন

আসলে বড় দুটি দলই প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন নিজ নিজ পক্ষে রাখার চেষ্টা করে থাকে। নির্বাচনের সময় দলগুলোর সেই চেষ্টা বেড়ে যায়, যা এবারও দৃশ্যমান হয়েছে। সে জন্য তারা বিদেশিদের তৎপরতাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে, এতে তাদের কোনো রাখঢাক নেই।

অনেক সময় আবার ক্ষেত্রবিশেষে দুই দলের অবস্থানের পার্থক্যও দেখা যায়। সিংহাসনে থাকলে একরকম এবং ক্ষমতার বাইরে থাকলে তাদের ভিন্ন মনোভাব প্রকাশ পায় বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে। যে দল ক্ষমতার বাইরে থাকছে, তাদের নির্বাচন, মানবাধিকারসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিতে দেখা যায়। ক্ষমতার আসনে থাকা দল তখন এর সমালোচনা করে থাকে। এ ছাড়া বিদেশিদের বক্তব্য যদি কোনো দলের বিপক্ষে যায়, তখন সেই দল সেটিকে চাপ এমনকি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে থাকে। ফলে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বিদেশি কূটনীতিকদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে দেশের সাধারণ মানুষেরও সন্দেহ নেই বলে মনে হয়।

এখন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকেরা বিভিন্ন বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত করা যায়—এমন বক্তব্য দিচ্ছেন পশ্চিমা কূটনীতিকেরা।

গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকা সফর করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় খাতরা। তখন তিনি বলে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর দেশের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এমনকি জাপানের কূটনীতিকদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলার নজির সেভাবে নেই। এবার নির্বাচন নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতের একটি মন্তব্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

যদিও বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ বা তৎপরতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের ক্ষেত্রে এবার প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকদের অনেকের বক্তব্যে কোনো না কোনো পক্ষে তাঁদের অবস্থান প্রকাশ পাচ্ছে। সে কারণেই বিদেশি হস্তক্ষেপ বা চাপের বিষয় নিয়ে এবার বেশি আলোচনা হচ্ছে।

দায় এড়াতে চায় বড় দুই দল

গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকের প্রশ্নে বলেন, তিনি নির্বাচনের আগে বিদেশি কোনো চাপ আমলে নিচ্ছেন না। এর পরদিনই গত মঙ্গলবার ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ওই বক্তব্য দেন । তাঁর সেই বক্তব্য ছিল—অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে, চীন তা সমর্থন করে। এমন বক্তব্য দিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত কোনো পক্ষ নিলেন কি না, এই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের অনেকে। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা একটি পক্ষ নিচ্ছে বলে ক্ষমতাসীনেরা মনে করছেন।

দুই দলের এমন স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও তারা নির্বাচনের আগে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাকে হস্তক্ষেপ বলতে রাজি নয়। এ ব্যাপারে তারা একমত বলে মনে হয়েছে। যদিও দেশের কোনো বিষয়ে এমনকি জাতীয় অনেক ইস্যুতেও দুই দলেরএকমত হওয়ার নজির খুব কম।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ-চীন রোড সিল্ক ফোরামের আয়োজনে যে অনুষ্ঠানে চীনের কূটনীতিক এ মন্তব্য করেন, সেই অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল মঈন খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু উপস্থিত ছিলেন।

আমির হোসেন আমু
বিএনপি নেতারা যেহেতু বারবার পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের কাছে যাচ্ছেন, সে জন্য তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন।
আমির হোসেন আমু আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য

আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘বিদেশি কূটনীতিকেরা নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য নির্বাচনের আগে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে আলোচনা করে থাকেন। উন্নয়নশীল দেশে তাঁরা এটা করে থাকেন।

এটাকে ভিন্ন কোনো দৃষ্টিতে দেখতে রাজি নন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অবস্থানও একই রকম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিদেশিদের কোনো হস্তক্ষেপ দেখছেন না।

তবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির কারণে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকেরা ভিন্ন ভিন্ন পক্ষ নিচ্ছেন কি না, এই প্রশ্ন রয়েছে দুই দলেই। বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন, চীন, ভারত ও রাশিয়া সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা দেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সমর্থনে কথা বলছেন। এ ধরনের ধারণা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে পশ্চিমাদের সমালোচনা করে বক্তব্যও দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতারা যেহেতু বারবার পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের কাছে যাচ্ছেন, সে জন্য তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থানে সমর্থনের কথা বলে চীনা রাষ্ট্রদূতও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য দিলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বিএনপির মহাসচিব

আবার বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং তাদের নৈতিকতা থেকে বাংলাদেশের নির্বাচনের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। তিনি মনে করেন, বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থানে সমর্থনের কথা বলে চীনের রাষ্ট্রদূতও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিলেন।

এদিকে গত কয়েক সপ্তাহে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকেরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। দুই দলই নির্বাচন নিয়ে তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন।

দুই দলের এ ধরনের অবস্থানকে দুর্বলতা হিসেবে দেখেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক এবং বামপন্থী দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপ হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছেন।

রাশেদ খান মেনন এই পরিস্থিতির জন্য দুই দলের দুর্বলতাকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকেরা যেভাবে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন, এটি অন্য কোনো দেশ—ভারত এমনকি পাকিস্তানেও তাঁরা করতে পারবেন না।

রাজনৈতিক বিরোধই মূল সমস্যা

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দেশের ন্যূনতম কোনো ইস্যুতেও ঐকমত্য নেই। বড় দুই দলের এই বিরোধের সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলো বিভিন্ন সময় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলে থাকে; আর নির্বাচনের আগে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়।

বিশ্লেষকেরা উদাহরণ হিসেবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের বিষয় তুলে ধরেন। তাঁরা সেটিকে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় আন্তর্জাতিক চাপের অভিযোগ করেছেন। তাঁর সেই অভিযোগের ইঙ্গিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। রাজনীতিতে বিরোধ থাকায় বিদেশিরা অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে থাকেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

নির্বাচনের আগে বিদেশিদের তৎপরতার বিষয়কে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ূন কবির। তিনি মনে করেন, বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বাংলাদেশে যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ আছে, সেই পটভূমিতে এই বিশ্বে এক দেশ অন্য দেশের অংশীদার হিসেবে সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে। এটি যেমন কূটনৈতিক সম্পর্কের অংশ; আবার উন্নয়ন সহযোগী হিসেবেও তারা কথা বলে থাকে।

তবে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের কারণে বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই বক্তব্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদেরও সন্দেহ নেই বলা যায়। কিন্তু তাঁদের বিরোধ যত দিন জিইয়ে থাকবে এবং নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারবেন না; তত দিন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের কথা বলার বা চাপ সৃষ্টির সুযোগ থেকে যাবে। বড় দুই দলেরও এর সঙ্গে দ্বিমত থাকার কথা নয়। তাঁরা কি কখনো সমাধানের পথে হাঁটবেন—সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে।