রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে মাশুল দিতে হবে: বদিউল আলম মজুমদার
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি শুধু নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন না করে, তাহলে এর মাশুল তাদের দিতে হবে। এর সঙ্গে হয়তো নাগরিকদেরও মাশুল দিতে হবে। সেই মাশুল যেন নাগরিকদের দিতে না হয়।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে বদিউল আলম মজুমদার এ কথা বলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এই সংলাপের আয়োজন করে।
জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সার্থকতা এর বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে বলে উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সনদটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আছে। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে এবং পরবর্তী সংসদে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে, এমন মনোভাব পোষণ করলে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
বদিউল আলম মজুমদার রাজনৈতিক দলগুলোকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেন। পাশাপাশি জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়, সে বিষয়ে দলগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনেরও বিশেষ ভূমিকা আছে। যেসব প্রস্তাব কমিশন দিয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ তাদের নিতে হবে। যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারে, কেন এগুলো করছে না কিংবা কেন করা হবে না, সে বিষয়টি জানাতে হবে।
অনুষ্ঠানে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, কোনো একটা বিষয়কে মৌলিক অধিকারের মধ্যে নেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পদের বরাদ্দের বিষয়টি যুক্ত। তাই মৌলিক অধিকারের মধ্যে যুক্ত হওয়া নতুন বিষয়গুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা স্পষ্ট নয়।
সনদ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে মুসলিম চৌধুরী বলেন, গণভোটের মাধ্যমেই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায়। এ ছাড়া প্রোক্লেমেশন করে পরবর্তী সংসদে সনদ পাস করা যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার বলেন, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও ঐকমত্য কমিশন সংলাপে পাঁচবার উত্থাপন করেছে। এ বিষয়ে প্রথম সংবিধান ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ব্যাপারে দলগুলো একমত না হওয়ায় কমিশন রাজনৈতিক দল কর্তৃক এক–তৃতীয়াংশ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব আনে। এতেও দলগুলো সম্মত হয়নি। এখন অনেকেই এ বিষয়ে কমিশনকে দোষারোপ করছেন। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে এখন যেটা হয়েছে, সেটা মন্দের ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মনির হায়দার বলেন, সংকটটা কেবল জুলাই সনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে দৃশ্যমান, অদৃশ্য আরও অনেক কিছু আছে। এগুলোর সমাধান হতে পারে কেবল রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোয় যে পরিমাণ নোট অব ডিসেন্ট আছে, তাতে কোনো একটা রাজনৈতিক দল যে ক্ষমতায় আসবে, তার আসলে এটাতে রাজনৈতিক কোনো সমস্যা হওয়ার কারণ নেই। ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসবে, তার স্বৈরাচারী ও আধিপত্যবাদী হওয়ার সুযোগ খুব একটা কমাবে না এই সনদ।
এতে নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদ কীভাবে গণভোটে দেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসিফ মোহাম্মদ সাহান। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নোট অব ডিসেন্টের ক্ষেত্রে ছাড় না দেয়, তাহলে সনদটি অর্থবহ পরিবর্তন আনবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা হাসান বলেন, তত্ত্বগতভাবে নাগরিকেরা দেশের মালিক হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না। যেমনটা দেখা গেছে, সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়। একটা কথা আছে ‘আর্ট অব দ্য পসিবল, যতদূর সম্ভব’, এমন একটা মনোভাব নিয়ে বর্তমানে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ঐকমত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে পরিমাণ নোট অব ডিসেন্ট এসেছে, তা বেশ হতাশাজনক। এতগুলো সংস্কার একসঙ্গে গণভোটে দেওয়া একটি জটিল বিষয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আসেনি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ বলেন, গণ–অভ্যুত্থানে ভাই মারা গেছে। তার হত্যার হুকুমদাতার বিচারকাজ চললেও তাঁরা এখনো জানেন না কোন পুলিশের গুলিতে সে মারা গেছে। একইভাবে অন্য শহীদ পরিবারেরাও বিষয়টি জানে না। তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন চলমান থাকে। পরবর্তী সরকারের সময় বিচার যেন থেমে না যায়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন। তিনি বলেন, জাতীয় সনদে উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলোর মধ্যে কতগুলো হলো মৌলিক সংস্কার, যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হবে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে সীমিত করা, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিধান, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও আনুপাতিক পদ্ধতিতে এর সদস্য নির্বাচিত করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দেওয়া, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও গঠনপদ্ধতি, সংসদের উভয় কক্ষের দুই–তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন করার বিধান, বিশেষায়িত কমিটির মাধ্যমে সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ ইত্যাদি।
একরাম হোসেন বক্তব্যে জুলাই জাতীয় সনদ থেকে কয়েকটি প্রাপ্তি তুলে ধরেন। যেমন মৌলিক অধিকারগুলোর সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রক্রিয়া, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম টানা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, সংবিধানের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোটদান, সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি।
জুলাই সনদের অপ্রাপ্তির বিষয়গুলোও তুলে ধরেন একরাম হোসেন। এগুলো হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মাধ্যমে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, স্থানীয় সরকারে ঘূর্ণমানপদ্ধতিতে নারীর আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জাতীয় সংসদে নারীদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, যা হতাশাজনক। ঘূর্ণমানপদ্ধতিতে ১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যাপারে জনমত থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো উদারতার পরিচয় দেয়নি; বরং বিদ্যমান আলংকারিক ৫০টি সংরক্ষিত আসনের বিধান বহাল আছে এবং নারীদের সরাসরি জিতে আসার সুযোগ বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে নারীর যথার্থ প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অধিকার পরাজিত হয়েছে এবং পুরুষতন্ত্রের জয় হয়েছে।
আরেকটি হতাশার বিষয় হলো অনেকগুলো মৌলিক বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল বারবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। প্রত্যাশা করা যায়, নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া দলগুলো অধিকাংশ দলের সম্মতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এগুলো মেনে নেবে। যেভাবে ১৯৭২ সালে গঠিত গণপরিষদে উত্থাপিত বেশ কিছু বিষয়ে কোনো কোনো গণপরিষদ সদস্যের দ্বিমত থাকলেও সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন।
প্রবন্ধের শেষ ভাগে একরাম হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এর সার্থকতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর, যা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, এ বিষয়ে দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছাবে ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলো।’
একরাম হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, সংস্কারের কোনগুলো সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, কোনগুলো অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, কোনগুলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর মধ্যে কোনগুলো আশু বাস্তবায়নযোগ্য, তা আলাদা করা দরকার।’
সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে ও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকারের সঞ্চালনায় নাগরিক সংলাপে বক্তব্য দেন সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরী, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা হাসান, সুজনের নির্বাহী সদস্য মুসবাহ আলীম, আইইউটির শিক্ষক আবদুল আজিজ প্রমুখ।