খোঁড়া অজুহাতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে

ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে তিনজন সংসদ সদস্যের সমালোচনার কোনো জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

জাতীয় সংসদ ভবনফাইল ছবি

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিভিন্ন অনিয়মের কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনজন সংসদ সদস্য। তাঁরা বলেছেন, খোঁড়া অজুহাতে কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কথা এলে সবার মধ্যে আতঙ্ক চলে আসে।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিল’ পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ ও হামিদুল হক খন্দকার এসব কথা বলেন। তবে সংসদ সদস্যদের সমালোচনার কোনো জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

বিলের আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পংকজ নাথ চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘নিয়ম না মেনে চারটি প্রতিষ্ঠানের ৬ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। আমি ডিটেলে (বিস্তারিত) গেলাম না, প্রতিষ্ঠানের নাম বললাম না।’

পংকজ নাথ বলেন, ‘এই বিশেষ অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়। ...জনতা ব্যাংক ধুঁকে ধুঁকে মরছে। বেসরকারি ব্যাংক এনবিএলের (ন্যাশনাল ব্যাংক) কী অবস্থা তা–ও জানি।’

সুদ মওকুফের সমালোচনা করে স্বতন্ত্র এই সংসদ সদস্য বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, দুর্বিপাকের কারণে সুদ মওকুফ হয়; কিন্তু কিছুই হয়নি, দুর্যোগও হয়নি। ল্যাংড়া–খোঁড়া অজুহাত দিয়ে সুদ মওকুফের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের নাম উল্লেখ না করে পংকজ নাথ বলেন, এক বিতর্কিত ব্যক্তির নাম নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা হচ্ছে দুর্নীতির কারণে। এক ব্যক্তি রাষ্ট্রের তিন–চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক, এনবিআরের সদস্য, আপিলাত ট্রাইবু৵নালের (এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল) চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ১৫ বছর আগে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে যেতে কে তাঁর নাম সুপারিশ করেছেন? শর্ষের মধ্যেই ভূত। এই ভূত প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ সরাতে পারবেন না।

বিলের আলোচনায় জাতীয় পার্টির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, পি কে হালদার টাকা নিয়ে ভারতে চলে গেছেন। অনেক কোম্পানি দেউলিয়া অবস্থায় আছে। যাঁরা লিজিং কোম্পানিতে টাকা রেখে নিঃস্ব, তাঁরা ফেরত পাবেন কি না, তা এই আইনে আছে কি না, সেটি বোধগম্য নয়। আইন হচ্ছে; কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।

হাফিজ উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাংক হয়ে গেছে। ১০–২০টি ব্যাংক আজ বন্ধের অবস্থায় আছে। তাদের আর্থিক অবস্থা নাজুক।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হামিদুল হক খন্দকার বলেন, ‌ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কথা এলে সবার মধ্যে আতঙ্ক চলে আসে।

স্বতন্ত্র এই সংসদ সদস্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–কর্মচারীরা ক্লাস বাদ দিয়ে আন্দোলন করছেন। তাঁরা সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে চাইছেন না। কারও ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না।

বিল পাস

গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব্যাংকের পাশাপাশি অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারীদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে ‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিল-২০২৪’ গতকাল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন। পরে বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।

এখন বাংলাদেশে পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশনস-২০১৪’ এবং ‘রেগুলেশনস অন ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার-২০১৪’ এর আওতায় সব পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত পৃথক কোনো আইন না থাকায় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক লেনদেন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিশোধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণেও কোনো আইন নেই। ফলে গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব্যাংকের পাশাপাশি অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারীদের আইনি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। এ কারণে এই আইন করা হচ্ছে।

বিলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ‘অগ্রিম পরিশোধ দলিল’ ইস্যু, ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া জনসাধারণ থেকে যেকোনো প্রকার বিনিয়োগ গ্রহণ, ঋণ প্রদান, অর্থ সংরক্ষণ বা আর্থিক লেনদেন উদ্ভব হয়, এরূপ কোনো অনলাইন বা অফলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করা যাবে না। এসব বিধান অমান্য করলে সাজা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ, পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনা বা ইলেকট্রনিক মুদ্রায় পরিশোধ সেবা দিতে পারবে না। একইভাবে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া কোনো পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনা বা পরিশোধ সেবা দিতে পারবে না। এই বিধান লঙ্ঘনের সাজা হবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।