ইভিএম নিয়ে ভোগান্তিতে ময়মনসিংহের ভোটাররা, আবার মেয়র ইকরামুল

আবার ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ইকরামুল হক। শনিবার ময়মনসিংহের প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পরছবি: দীপু মালাকার

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শনিবার সকালে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। দুপুরের দিকে কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারিও দেখা যায়। তবে ভোট গ্রহণের গতি ছিল ধীর৷ মূলত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের।

ইভিএমে ভোট দেওয়ার আগে প্রত্যেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলাতে হয়। এ নিয়েই বিপত্তি দেখা দেয়।

প্রথমবার আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোটারদের অনেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার চেষ্টার পর সফল হন। অনেকের কোনোভাবেই আঙুলের ছাপ মিলছিল না। এতে ভোট গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। যে কারণে নির্ধারিত সময় বিকেল চারটার পরও কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করতে হয় (ভোট দিতে যাঁরা কেন্দ্রের ভেতরে লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন)।

ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ১২৮টি। গত রাত সাড়ে ১০টায় সব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তাতে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬০৪ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ইকরামুল হক (ঘড়ি প্রতীক)। তিনি ময়মনসিংহ সিটির সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান (হাতি প্রতীক) পেয়েছেন ৩৫ হাজার ৭৬৩ ভোট। আর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেসামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক) পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৭৩ ভোট। আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক) পেয়েছেন ১ হাজার ৪৮৭ ভোট। জাতীয় পার্টির প্রার্থী শহিদুল ইসলাম (লাঙ্গল) পেয়েছেন ১ হাজার ৩২১ ভোট। ভোটের হার ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এবার ময়মনসিংহের পাশাপাশি কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দুই সিটির ভোটে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ভোটকেন্দ্র ১২৮টি। গতকাল সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরুর পর থেকে বিকেল পর্যন্ত ১০টি ওয়ার্ডের ২০টি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক ও একজন আলোকচিত্রী। সকাল ১০টার দিকে ময়মনসিংহ শহরের কালীবাড়ি এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুলে নারী ভোটকেন্দ্র গিয়ে দেখা যায়, ইভিএম জটিলতার কারণে ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিলেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে ভোটার লাইলী বেগম ও ভারতী রানীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।

লাইলী বেগম বলেন, সকাল আটটার পর ভোট দিতে কেন্দ্রে আসেন তিনি। দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পরও ভোট দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এত জটিল জিনিস আমাদের জন্য না।’

এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব আস্তে আস্তে লাইন আগাচ্ছে। আনসাররা বলছে, আরও নাকি দুই ঘণ্টা দাঁড়ায় থাকা লাগবে।
সাবরিনা আক্তার, নাসিরাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নতুন ভবন কেন্দ্রের ভোটার

অন্যদিকে ভারতী রানী বলেন, ভ্যাসলিন (হাতে-ঠোঁটে ব্যবহার করার প্রসাধনী) দিয়ে অনেকক্ষণ আঙুল ঘষলেও কাজ হয়নি। ইভিএমে আঙুলের ছাপ মিলছিল না। হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে লেবু দিয়ে কচলে দুপুরের পর আবার তাঁকে ভোটকেন্দ্রে আসতে অনুরোধ করেছেন কর্মকর্তারা। তবে তিনি আর আসতে চান না।

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের সঙ্গে সকাল সোয়া ১০টার দিকে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় চলে যাচ্ছে একেকজনের আঙুলের ছাপ মেলাতে। এভাবে চললে ভোট কতটা পড়বে বোঝা যাচ্ছে না। অনেককেই আবার দুপুরে আসতে বলে দিতে হচ্ছে।’

এই ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি ভোটকক্ষে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সামনে পেট্রোলিয়াম জেলির (একধরনে প্রসাধনী) ছোট কৌটা রাখা ছিল। ইভিএম মেশিনে আঙুলের ছাপ মেলাতে ভোটারের হাতে সেই প্রসাধনী ঘষছেন কর্মকর্তারা। অনেকটা সময় ঘষাঘষির পরও অনেক ভোটার, বিশেষ করে বয়স্ক ও নারীদের আঙুলের ছাপ মিলছিল না।

ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কমিশন অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রীর সঙ্গে ভ্যাসলিন ও টিস্যুও দিয়েছে। ইভিএমের সমস্যা ছাড়াও ভোট গ্রহণে ধীরগতির কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, অনেক ভোটার গোপন কক্ষে যাওয়ার পর বুঝতে পারছেন না, কী করবেন। এর ফলেও ভোটারদের দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তারা বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, কীভাবে ভোট সম্পন্ন (ভোট দেওয়ার গোপন বুথ) করতে হবে।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে ভোগান্তির কথা সকালেই সাংবাদিকদের জানান মেয়র প্রার্থী ইকরামুল হকও। তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে ভোগান্তি হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুলে দেখা যায়, নারী ও পুরুষ দুই কেন্দ্রের সামনেই ভোটারদের দীর্ঘ সারি। নারী কেন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর কক্ষের সামনে সারি ছিল বেশ লম্বা। ২ নম্বর কক্ষে মনোয়ারা বেগম নামের এক ভোটারের আঙুলের ছাপ মেলানোর চেষ্টা করছিলেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। ভ্যাসলিন ঘষেও কাজ হচ্ছিল না। এভাবে চলে ৭ মিনিট। তারপর হতোদ্যম হয়ে মনোয়ারা বেগমকে পরে আসতে বলেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।

এই ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বুলা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় সব ভোটারেরই আঙুলের ছাপ মেলাতে ৬-৭ মিনিট লাগছে। আবার গোপন কক্ষে গিয়েও ভোটাররা বুঝতে পারছেন না কী করবেন। একজনের ভোট নিতেই ৮-৯ মিনিট লাগছে।’

নারীদের উপস্থিতি ছিল বেশি

সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রের সামনে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নাসিরাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মূল ভবনের নিচতলায় নারী ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৭২৪ জন। এই কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৬৫০টি (২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ)।

নারী কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খালেদ মাহমুদ বলেন, ইভিএমে ভোট দিতে নারীরা সমস্যায় পড়ছেন। বিশেষ করে বয়স্ক নারীদের আঙুলের ছাপ মেলাতে সমস্যা হচ্ছে।

ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে শহরতলির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়েরা উজানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের সারি। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

নাসিরাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ভোটকেন্দ্রে মোট পাঁচটি ভোটকক্ষ। এর তিনটি নারীদের ও দুটি পুরুষ ভোটারের। দেখা যায়, তিনটি নারী ভোটকক্ষের সামনেই ভোটারদের দীর্ঘ সারি। বাঁশবাড়ী এলাকা থেকে আসা সাবরিনা আক্তার বলেন, ‘এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব আস্তে আস্তে লাইন আগাচ্ছে। আনসাররা বলছে, আরও নাকি দুই ঘণ্টা দাঁড়ায় থাকা লাগবে।’

এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, নারী ভোটারদের উপস্থিতি বেশি, কিন্তু ভোট গ্রহণের গতি কম। তাই গতি বাড়াতে পুরুষ কক্ষের একজন সহকারী কর্মকর্তাকে নারী ভোটকক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে।

এই কেন্দ্রের ২ নম্বর নারী ভোটকক্ষে পোলিং কর্মকর্তাকে গোপন কক্ষে উঁকি দিয়ে এক ভোটারকে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। কক্ষে থাকা বিভিন্ন প্রতীকের এজেন্টরা বলেন, ভোটাররাই ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন কী করতে হবে। সবার অনুমতি নিয়ে পোলিং কর্মকর্তা দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ভোট দিতে হবে।

শহরতলিতে ভোটারদের দীর্ঘ সারি

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের শহরতলির ওয়ার্ডগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশি। ২৯ নম্বর ওয়ার্ডটি সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডের বাড়েরা উজানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় দেখা যায়, নারী ও পুরুষ ভোটারদের সারি বেশ দীর্ঘ।

কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আলমগীর জলিল প্রথম আলোকে বলেন, এ কেন্দ্রের মোট ভোট ২ হাজার ২৯৯টি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৮০৮টি।

কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভোটার উপস্থিতি। বিকেল চারটার পরেও কয়েকটি কেন্দ্রের সামনে অনেক ভোটার লাইনে ছিলেন।

শহরের পাটগুদাম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষদের দুটি ভোটকেন্দ্র। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ভোটারদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিকেল চারটার সময়ও এই কেন্দ্রের সামনে অন্তত অর্ধশত ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন। শনিবার সকাল সোয়া আটটার দিকে তোলা ছবি
ছবি: দীপু মালাকার

গতকাল বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, কয়েকটি কেন্দ্রে চারটার পরও ভোট নেওয়া হয়েছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠিত হয় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে। এরপর ২০১৯ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সিটি নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন ইকরামুল হক।

এবারের নির্বাচনে ভোটারদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ইভিএমের কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। এ ছাড়া ইভিএম নিয়ে মানুষের সন্দেহ-অবিশ্বাস রয়েছে। ইভিএম নিয়ে মানুষের অনভ্যস্ততা যেমন রয়েছে, তেমনি এটি যে কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়, সেটি ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার বোঝা গেল।