ভোট নিয়ে আলোচনা বেশি আওয়ামী লীগ আর ইসলামী আন্দোলনে

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের বাকি মাত্র দুই মাস। কিন্তু এখন পর্যন্ত শহরে ভোটের উত্তাপ নেই, নেই কোনো আমেজ। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না।

জাতীয় নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে এই সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে খুলনায় সরব মূলত দুটি দল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এর বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর খুব একটা তৎপরতা নেই। ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বলেছে, তারা এই নির্বাচনে অংশ নেবে না। আর সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতারা বলছেন, নির্বাচনে দাঁড়াতে দলের কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই নিরস অবস্থার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, ভোট নিয়ে গত এক দশকের অভিজ্ঞতা, বিএনপির মতো বড় দল ভোটে না থাকা, আওয়ামী লীগ যাকে মনোনয়ন দেবে, তিনিই বিজয়ী হবেন—এমন ধারণা তৈরি হওয়া, স্থানীয় আওয়ামী লীগের এককেন্দ্রিক আধিপত্য এবং রোজা; এসব কারণে নির্বাচনের আমেজ নেই।  

সাধারণত ভোটের তারিখের দেড় মাস আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম হল খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে। দুই মাসের বেশি সময় আগে ভোটের সময়সূচি ঘোষণা করে দেয় ইসি। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে আগামী ১২ জুন। তার আগে বাংলা নববর্ষ ও ঈদের মতো বড় দুটি উৎসব। নির্বাচনের আগে আগে এ ধরনের উৎসবগুলোকে নিজেদের প্রচারের বড় উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এলাকার জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার, ফেস্টুন ঝুলিয়ে নিজেদের কথা জানান দেন তাঁরা। খুলনা শহরে যে সেটা একেবারে হয়নি তা নয়। তবে তা খুব বেশি চোখে পড়ার মতো না। দু–তিনজন সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীর পোস্টার ফেস্টুন শহরের বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে। এর বাইরে অলিগলিতে আছে সম্ভাব্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোস্টার। সেটাই সংখ্যায় বেশি হবে। এখন পর্যন্ত খুলনায় নির্বাচনের আমেজ বলতে এটুকুই।

নিজ থেকে আলাপ না জমালে ভোটের আলাপ কানে আসে না। নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ছোট রেস্টুরেন্ট চালান মো. মুরাদ। তিনি ইফতার তৈরির কাজ দেখভাল করছিলেন। নির্বাচনের কথা তুলতে জানালেন, ঈদের পর ভোট হবে বলে জানেন। তবে কত তারিখে, তা তিনি জানেন না। আগেরবার ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের সময় তাঁর দোকানে নির্বাচন ঘিরে জমজমাট আড্ডা হতো। এবার এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনাই নেই। এর কারণ কী? এমন প্রশ্নে মুরাদের জবাব, ‘বর্তমান বাজার সিলেকশনের ভোট, ইলেকশনের ভোট হয় না বললে চলে।’ সিলেকশনের ভোটের ব্যাখ্যায় তিনি যা বললেন, সেটা হলো ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা যাঁকে প্রার্থী হিসেবে বাছাই করবে, তিনিই নির্বাচিত হবেন।

নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁদের একজন হাওলাদার ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ভোট নিয়ে আলোচনা চোখে পড়ে না। তিনি মনে করেন, এর বড় কারণ বিএনপি বলছে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপি না থাকলে ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না। তাই মানুষের আগ্রহ নেই। তবে রোজার পরে হয়তো প্রার্থীদের তৎপরতা বাড়বে। তখন কিছুটা ভোটের আমেজ পাওয়া যেতে পারে।

আওয়ামী লীগে মনোনয়ন চান চারজন

খুলনায় মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে আছেন চারজন। বর্তমান মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক, মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক মো. আশরাফুল ইসলাম, সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য রুনু রেজা (রুনু ইকবাল বিথার) দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। রুনু রেজা খুলনা মহানগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ইকবাল বিথারের স্ত্রী।

বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম আলকে বলেন, তিনি বর্তমান মেয়র, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। দল তাঁকে মনোনয়ন দিলে তিনি প্রার্থী হবেন। দল যে সিদ্ধান্ত দেবে, তিনি সেটা মেনে নেবেন।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যে রকম প্রকাশ্য, খুলনায় তেমন নয়। তবে খুলনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীনের প্রভাব রয়েছে।

খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান মেয়র ২০১৮ সালে বলেছিলেন, তিনি শেষ সুযোগ চান। তবে এবারও তিনি প্রার্থী হতে চান, এটা চাইতেই পারেন। তবে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে এবার প্রার্থী পরিবর্তন হওয়া দরকার। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মতো প্রায় সমান বরাদ্দ খুলনা সিটিও পেয়েছিল। কিন্তু উন্নয়ন একইভাবে হয়নি। হয়তো খুলনায় কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। যদি মানুষ মনে করে প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ নেই, তাহলে ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তিনি তাঁর জন্যই কাজ করবেন।

প্রার্থী নিয়ে মাঠে ইসলামী আন্দোলন

আওয়ামী লীগ এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত না করলেও এদিকে এগিয়ে আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটি গত ২০ মার্চ আবদুল আউয়ালকে তাদের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। দলটি ওয়ার্ডভিত্তিক ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে ভোটের কৌশলী প্রচার চালাচ্ছে।

ইসলামী আন্দোলনের খুলনা সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান শেখ মো. নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নির্বাচনী কাযর্ক্রম চালাচ্ছেন। তবে মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা নেই। কারণ দিনের ভোট রাতে হয় এমন অভিজ্ঞতা আছে।  

নির্বাচন নিয়ে চিন্তা নেই বিএনপির

বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। এই নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা সমালোচনাও তারা করতে চান না। অবশ্য দলটির সূত্র জানায়, দলের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন নির্বাচনে যাওয়া প্রয়োজন। আর কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক দলের কয়েকজন নেতা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত নির্বাচনে বিএনপির ১৮ জন নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল আলম (তুহিন) প্রথম আলোকে বলেন,  বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে যারা আছে, তাদের কেউ এই নির্বাচনে অংশ নেবে না। আর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম (মনা) বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রার্থী পাচ্ছে না জাপা

জাতীয় পার্টি এই নির্বাচনে অংশ নেবে এমন সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু দলটি প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। দলের নেতাদের কেউ প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। খুলনা মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, এখন ভোটে অনেক ক্ষেত্রেই দল বা ব্যক্তির ইমেজ কাজ করে না। সব ভোট পায় সরকারি দল। অন্যরা এত কম ভোট পায় যে জামানতই থাকে না। তাই টাকাপয়সা খরচ করে কেউ প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

রাজনৈতিক দলের বাইরে দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। এর একজন এস এম মুশফিকুর রহমান। শহরে নির্বাচন ঘিরে যত পোস্টার ফেস্টুন এর বড় অংশই তাঁর। গত বার তিনি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে পেয়েছিলেন এক হাজার ৭২ ভোট।

এ ছাড়া আগুয়ান-৭১ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক মো. আবদুল্লাহ চৌধুরী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে গতবার নির্বাচনে বাম জোটের প্রার্থী ছিলেন সিপিবির মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এবারও নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

মূলত ২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এরপর বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ২০১৮ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আগে পুলিশের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠছাড়া করা হয়েছিল। ওই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ‘নতুন মডেল’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ওই আলোচিত নির্বাচনের পাঁচ বছরের মাথায় আবার নির্বাচন এলেও এখনো নিরুত্তাপ খুলনা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের কোনো আমেজ নেই। একেবারে নিরুত্তাপ নির্বাচন। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ভোটের আমেজ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া এখানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিও এককেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগ যাকে মনোনয়ন দেবে তিনি মেয়র হবেন, ধরে নেওয়া যায়। এসব কারণে নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই।