জাকসু নির্বাচনে প্রচারের মঞ্চ এখন ফেসবুক

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের প্রচারের মঞ্চ যেন হয়ে উঠেছে ফেসবুক। সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমেও সরব প্রার্থীরা। এখানে দেওয়া আধেয় (কনটেন্ট) টানছে ভোটারদের, ক্যাম্পাসে বাড়াচ্ছে আলোচনা।

প্রার্থীরা বলছেন, ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা বেশি সক্রিয়। সশরীরের চেয়ে অনলাইনে ভোটারদের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছানো যায়। তাই তাঁরা সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন তথা ফেসবুক প্রচারেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল, ভবন, শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হলে কোনো লিফলেট বা পোস্টার লাগানো যাবে না। শুধু নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আবাসিক হল ও অনুষদ ভবনের নিচে দেওয়া নির্বাচনী বোর্ডে তাঁরা লিফলেট সাঁটাতে পারবেন। তবে প্রচারের বোর্ডের পরিমাণ বেশি না হওয়ায় অনেক প্রার্থী সেখানে ঠিকমতো জায়গা পাচ্ছেন না। আবার এসব বোর্ডে সাঁটানো পোস্টার ভোটারদের কতটা আকৃষ্ট করতে পারছে, তা নিয়েও প্রার্থীদের প্রশ্ন রয়েছে। তাই তাঁরা অনলাইন মাধ্যমকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জাকসুতে পদ রয়েছে ২৫টি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৭৯ জন।

গানে গানে প্রচার

‘আইলো আইলো, আইলো রে, রঙ্গে ভরা জাকসু আবার আইলো রে’ শিরোনামে একটি গান গেয়ে অনলাইনে প্রচার করে নজর কেড়েছেন ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ প্যানেলের প্রার্থীরা। দেড় মিনিটের ওই ভিডিও আপলোড করে ফেসবুকে বেশ সাড়া পেয়েছেন তাঁরা। ছোট ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গানের শেষে প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মাহফুজ ইসলাম মেঘ বলছেন, ‘৩৩ বছর পর যে জাকসু এসেছে, সেটা আপনার, আমার, আমাদের সকলের। আপনার ভোটেই নির্ধারিত হবে যোগ্য প্রার্থী কে। যেই জয়ী হোক না কেন, সেটা যেন আপনার ভোটের মাধ্যমে হয়। তাই কেউ হল ছাড়বেন না, সবাই হলে থাকবেন, নিজের ভোট শতভাগ নিশ্চিত করবেন।’

‘৩৩ বছর পরে এল জাকসু, আনন্দে মেতেছে ক্যাম্পাস; বটতলা, মুরাদ কিংবা টারজানে..সবখানে লেগেছে আজ উৎসব, মনে জেগেছে উল্লাস’ শিরোনামে কাওয়ালি ঢঙে গান গেয়ে ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন রাহাতুল ফেরদৌস রাত্রী। তিনি প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের একাংশের প্যানেল ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ থেকে জাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে লড়ছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতবিষয়ক সংগঠন জলসিঁড়ির সভাপতি।

ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। এতে গীতিকার আপেল মাহমুদের ‘জীবন কাটে যুদ্ধ করে, প্রাণের মায়া সাঙ্গ করে’ গান গাইতে দেখা যায় প্রার্থীদের।

ছাত্রদল প্যানেল থেকে সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন জাহিদ হাসান খান। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রয়াত মান্নার ‘আম্মাজান আম্মাজান, আপনি বড়ই মেহেরবান’ গানের সুরে সুরে জাহিদের সমর্থকেরা ‘জাহিদ ভাই জাহিদ ভাই; আপনার কোনো চিন্তা নাই’ গান গেয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, প্রার্থী জাহিদ গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছেন।

ফেসবুকে ঢুকলেই জাকসু নির্বাচনের আমেজ বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রার্থীরা এত সৃষ্টিশীল, জাকসু না এলে হয়তো দেখতে পেতাম না।
সুমাইয়া মাহাজাবিন, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ

সিনেমার টিজার ও জার্সি নাম্বার

হরর সিনেমার টিজারের আদলে ২ মিনিট ২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও নিজের প্রোফাইলে প্রচার করে সাড়া ফেলেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মো. সোহেল রানা৷ ভিডিওটি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে প্রশংসাও করেছেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, হরর সিনেমার মতো অন্ধকারে কালো রঙের পোশাক পরে হেঁটে যাচ্ছেন সোহেল। তাঁর হাতে একটি লিফলেট, যেখানে লেখা, মোস্ট ওয়ান্টেড। ভিডিওটি ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজারের বেশি মানুষ দেখেছেন।

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেল থেকে স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন মো. রায়হান। জাকসুর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী তাঁর ব্যালট নম্বর ৭। তিনি ফেসবুকে মিমের আদলে একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেছেন। যার এক পাশে লেখা ‘কুষ্টিয়ার রোনালদো ৭’, অন্য পাশে লেখা ‘স্বাস্থ্য ও খাদ্যে ব্যালট ৭’।

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল থেকে কার্যকরী সদস্য পদে প্রার্থী হয়েছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সুলতানা ছিয়া। তাঁর ব্যালট নাম্বার ৭। তাঁর একটি ফটোকার্ড ফেসবুকে ঘুরছে। ওই ফটোকার্ডে কোমল পানীয় সেভেন আপ-এর বোতল দিয়ে ভোটারদের তাঁর ব্যালট নাম্বার ৭ জানান দিচ্ছেন।

সক্রিয় ফেসবুক গ্রুপ

বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক দুটি ফেসবুক গ্রুপে প্রার্থীরা প্রচার চালাচ্ছেন বেশি। গ্রুপ দুটি হলো ‘জাবির সকল সংবাদ’ ও ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’। এগুলোতে প্রার্থীরা লিফলেট, পোস্টার ও ইশতেহার এবং বিভিন্ন প্রমোশনাল ভিডিও পোস্ট করছেন। ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’ গ্রুপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান মিলে ৪৬ হাজার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত রয়েছে। অন্যটিতে এ সংখ্যা ৫০ হাজার।

এই দুটি ফেসবুক গ্রুপের গত তিন দিনের পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট ৫২২টি পোস্ট করেছেন প্রার্থীরা। বেশির ভাগ পোস্ট প্রার্থীরা নিজেরাই করেছেন।

এ বিষয়ে ‘জাবির সকল সংবাদ’ গ্রুপের একজন অ্যাডমিন ওয়াজহাতুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে প্রার্থীরা এত পরিমাণ পোস্ট করছেন যে সেগুলো অ্যাপ্রুভ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। তবে এদিক থেকে ভালোই লাগছে প্রার্থীরা সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন প্রচারকেও অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’

প্রার্থীদের এমন অনলাইন প্রচারকে অনেক শিক্ষার্থীই নির্বাচনী আমেজের অংশ হিসেবে দেখছেন। যেমন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া মাহাজাবিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনের ক্লান্তি শেষে যখন ফেসবুকে ঢুকি, তখন প্রার্থীদের এসব ভিডিও, ফটোকার্ড দেখে খুবই আনন্দ লাগে। ফেসবুকে ঢুকলেই জাকসু নির্বাচনের আমেজ বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রার্থীরা এত সৃষ্টিশীল, জাকসু না এলে হয়তো দেখতে পেতাম না।’