খালেদা জিয়া সংগ্রাম, সাহস, দেশপ্রেমের অনন্য উদাহরণ
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ, দেশের জনগণ, এমনকি বিশ্বের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। দেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সংগ্রাম, সাহস, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, সততা ও নীতিনিষ্ঠতার এক অনন্য উদাহরণ। তাঁকে ছাড়া একটি বাংলাদেশ কল্পনা করা আমার জন্য বেশ কঠিন বিষয়।
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আগমন হয়েছিল। তিনি মূলত একজন গৃহবধূ ছিলেন, যাঁর কাজ ছিল সংসার ও সন্তান পালন করা। ১৯৮১ সালে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর দলের ঐক্যের স্বার্থে তিনি রাজনীতিতে আসেন। স্বামীর মৃত্যুর সাত মাস পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সদস্য হন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।
বেগম জিয়া যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন দেশে সামরিক শাসক এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছিল। তিনি সেই বৈরী পরিবেশে গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন সংগ্রাম শুরু করেন। শুরুতে জনসভায় ভাষণ দেওয়ার অভ্যাস না থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেই দক্ষতা অর্জন করেন এবং একজন ক্যারিশমাটিক নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। মানুষ তাঁকে হৃদয়ে স্থান দেয় এবং তাঁর নেতৃত্ব সাধারণ মানুষকে প্রবলভাবে উদ্বেলিত করে তোলে।
বেগম জিয়া জানতেন, এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে তা স্বৈরশাসককে বৈধতা দেবে, তাই তিনি এরশাদ আমলের কোনো নির্বাচনেই অংশ নেননি। লক্ষণীয় হলো, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের একই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক বৈধতা লাভের জন্য জামায়াত হয়তো আওয়ামী লীগকে অনুসরণ করেছিল।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন ৭-দলীয় জোট, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮-দলীয় জোট এবং বামপন্থীদের ৫-দলীয় জোট এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে এরশাদের পতন ঘটে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় তিনি কোনো আপসের পথে হাঁটেননি। এর ফলে তিনি আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি আসন লাভ করে এক অভাবনীয় ‘মিরাকল’ ঘটায়। ভোটের আগে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। সে সময় আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি ছিল তুলনামূলক কম। কিন্তু এরপরও বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করে। আমার মতে, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণেই বিএনপি সেই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ কারণে বিএনপিকে তখন জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। প্রথমবারের মতো একজন নারী বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।
সরকার গঠনের পরপরই আওয়ামী লীগ সেই সরকারকে অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৩ দিন হরতাল ডাকা হয়। একপর্যায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি সামনে আসে। প্রথমে অনড় থাকলেও জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়া এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এ থেকে বোঝা যায়, আপসহীন নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও যৌক্তিক যেকোনো বিষয় তিনি বিবেচনায় নিতেন।
খালেদা জিয়া সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু খেয়াল করার বিষয় হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংসদে পাস করতে হলে তখন ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প ছিল না। এর কারণ হলো, আগের সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সদস্যরা পদত্যাগ করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪-দলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসে। কখনো কখনো এ রকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আশীর্বাদের চেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, সুযোগসন্ধানীরা নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সুযোগ পায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এ রকম কিছু ঘটনা ঘটে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি কে এম হাসানের নিয়োগ নিয়ে সংকট তৈরি হলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই সেই দায়িত্ব নেন, যা তীব্র রাজনৈতিক সংঘাত ও জটিলতা তৈরি করে। এরপর ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে এবং সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে খালেদা জিয়ার পরিবারের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। তাঁর দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয় এবং খালেদা জিয়াকেও কারাবরণ করতে হয়। শত চাপের মুখেও তিনি বিদেশ যেতে রাজি হননি এবং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশই আমার শেষ ঠিকানা।’
দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হলেও খালেদা জিয়া দেশে থেকে যান এবং চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়েছিল, তা ছিল বিএনপির প্রতি বৈরী। এর ফলে নির্বাচনে বিএনপির ভালো ফল করার কোনো সুযোগ ছিল না। এ রকম পরিস্থিতিতেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরবর্তী ১৫ বছরে দেশে একধরনের স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম হয়। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা গুম-খুনের শিকার হন, আয়নাঘর বানানো হয়। বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় এবং তাঁকে দীর্ঘ সময় পরিত্যক্ত নির্জন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। সেখানে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে পরে তাঁকে গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এটা ইতিবাচক বিষয় ছিল যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অপেক্ষায় থাকা একটি দেশে তিনি মুক্তভাবে ফিরতে পেরেছিলেন। ২১ নভেম্বর ২০২৫-এ সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁকে শেষবারের মতো জনসমক্ষে দেখা যায়। এর দুই দিন পর তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অবশেষে গতকাল মারা গেলেন।
খালেদা জিয়া এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি নীতির প্রশ্নে বা দেশের স্বার্থে কখনোই আপস করেননি এবং কোনো বৈদেশিক শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। দেশের রাজনৈতিক সংকটময় মুহূর্তে একজন অভিভাবক হিসেবে তাঁর ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। তাঁর এই প্রস্থান তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করবে।
ড. মাহবুবউল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ