বাধা ঠেলে বড় জমায়েত খুলনায়

আগের রাতেই বিএনপির হাজার হাজার নেতা–কর্মী–সমর্থক পাটি, ত্রিপল, পলিথিনের বিছানা পেতে সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন।

খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি। গতকাল দুপুরে নগরের সোনালী ব্যাংক চত্বরে
ছবি: আলীমুজ্জামান

আগে থেকে স্থলপথ ও জলপথ বন্ধ। ছিল পথে পথে বাধা, হুমকি, সীমাহীন দুর্ভোগ, কোথাও কোথাও পুলিশি হয়রানি। সমাবেশ চলার সময়েও দিনভর শহরে ছিল সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মহড়া। সব ধরনের বাধা ডিঙিয়ে বিএনপি গতকাল শনিবার খুলনায় বড় গণসমাবেশ করেছে।

এই ‘সফলতার’ জন্য খুলনা বিভাগের নেতা-কর্মীদের অভিবাদন জানান গণসমাবেশের প্রধান অতিথি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আপনারা অসাধ্যকে সাধন করেছেন। তিন দিন ধরে জলে-স্থলে সব পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুই চলতে দেয়নি। তারপরও কি আপনাদের গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে বাধা দিতে পেরেছে? ইতিহাস বলে, শুধু বল প্রয়োগ করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না।’

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, দলের পাঁচ নেতা-কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ কর্মসূচি দেয়। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের পর খুলনার গতকালের এ সমাবেশকে ঘিরে কয়েক দিন ধরেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উত্তেজনা চলছিল। নানামুখী বাধাবিপত্তির মধ্যেই গতকাল খুলনা শহরের সোনালী ব্যাংক চত্বরে এ সমাবেশে দলটির নেতা-কর্মীদের বিপুল উপস্থিতি দেখা গেছে।

বাধা ও গণপরিবহন বন্ধের কারণে খুলনা বিভাগের অধীন ১০ জেলার অনেক নেতা-কর্মী দুদিন আগেই শহরে ঢুকে পড়েন। পিকআপ, অটোরিকশা, নছিমন ও ভটভটি, ট্রলারসহ নানা যানবাহনে, কেউ কেউ হেঁটেও খুলনায় পৌঁছান। তাঁরা হোটেলে, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনের বাসাবাড়িতে ওঠেন।

এই সরকার আবারও একই কায়দায় ভোট নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব, বিএনপি

সমাবেশের আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যার পরপর এসব নেতা-কর্মী সমাবেশস্থলে আসা শুরু করেন। রাতেই হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক সেখানে পাটি, ত্রিপল, পলিথিন ও বিছানা পেতে অবস্থান নেন। মধ্যরাত থেকেই মঞ্চে বক্তৃতা শুরু হয়। গতকাল দুপুরের আগেই সমাবেশস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে জমায়েত সোনালী ব্যাংক চত্বর থেকে যশোর রোডের

পাওয়ার হাউস ছাড়িয়ে সংগীতা সিনেমা হল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আশপাশের খানজাহান আলী সড়ক, শেরেবাংলা সড়কসহ আশপাশেও লোকজন অবস্থান নেন।

সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব অভিযোগ করেন, গত দু-তিন দিনে বিএনপির পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। অনেক নেতা-কর্মীকে মারধর করা হয়েছে। রূপনগরে ২০ জন ও কেশবপুরে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মোংলায় ট্রলারে আসা প্রায় ১০০ জন নেতা-কর্মীকে মেরে আহত করার পরে ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া ১০০ নেতা-কর্মীকে আহত করা হয়েছে। বাগেরহাটের মিছিলে হামলায় আহত হয়েছেন আরও ৭০ জন নেতা-কর্মী। সেখানে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খুলনা নদীবন্দরের ৫ ও ৭ নম্বর ঘাটে আসা ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে নেতা-কর্মীদের মারধর এবং দুদিন ধরে খুলনা শহরে সরকারি দলের কর্মীদের হকিস্টিক উঁচিয়ে মোটরসাইকেল মহড়ার কথাও উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।

বিএনপির সমাবেশে সরকার বাধা দিচ্ছে না, বরং সহযোগিতা করছে—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের এ বক্তব্য নাকচ করে দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি ‘সীমাহীন বাধার’ কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘কী সহযোগিতা করেছেন? স্টেশনে নামার পরে আমাদের ছেলেদের গ্রেপ্তার করেছেন। আমাদের চোখের সামনে আমাদের ছেলেমেয়েদের কুপিয়েছে। আপনারা কিছুই বলেননি। বরং খেয়াঘাটে গ্রেপ্তার করেছেন, আহত করেছেন। যাতে সমাবেশে যোগ দিতে না পারে, তার ব্যবস্থা করেছেন।’

চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের মতো খুলনার সমাবেশের মঞ্চেও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্মরণে একটি চেয়ার খালি রাখা হয়। এটা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) আমাদের বলেছেন যে তোমরা সঠিক পথে আছ, এভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাও। জনগণের অধিকারকে আদায় করে নিয়ে আসো। আমরা সে জন্যই তাঁর স্মরণে এই চেয়ারটি খালি রেখেছি।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, আজকে দেশকে একটা নরকে পরিণত করেছে এই অবৈধ সরকার। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, সব অর্জন ধ্বংস করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। তারা জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। তারা বিনা ভোটে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।

এ সময় বিএনপির মহাসচিব উপস্থিত নেতা-কর্মীদের কাছে জানতে চান, ‘২০১৪ সালে ভোট দিতে পরেছিলেন? ২০১৮ সালে ভোট দিতে পেরেছিলেন?’ জবাবে নেতা-কর্মীরা ‘না’ ধ্বনি উচ্চারণ করলে মির্জা ফখরুল বলেন, ২০২৩ সালে আবার নির্বাচন আসছে। এই সরকার আবারও একই কায়দায় ভোট নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁয়তারা শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলছি, এই দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সুতরাং আর কোনো কথা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিলে কোনো নির্বাচন হবে না। সে জন্য এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।’

খাদ্যাভাবের আশঙ্কা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যের কথা উল্লেখে করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। কেন? আপনি তো ঘোষণা দিয়েছেন যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, অমর্ত্য সেন এই দুর্ভিক্ষের ওপর বইয়ে লিখলেন, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার জন্য, তাঁদের দুঃশাসনের জন্য, লুটপাটের কারণে। আজকে আবার সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, আবার সেই আগের মতো সারা বাংলাদেশকে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তাহলে তরুণ যুবকদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। যারা মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি করেছে, কমিশন গঠন করে তাদের খুঁজে বের করবে। তিনি বিএনপির গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তি এবং সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘অন্যথায় পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না। এখনো সময় আছে, মানে মানে পদত্যাগ করুন, নিরাপদে চলে যান।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার ভীত হয়ে খুলনায় অঘোষিত হরতাল ঘোষণা করে খুলনা বিভাগকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে। যদি এই বাধার সৃষ্টি না করত, তাহলে জমায়েত দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়ে খুলনা শহর বন্ধ হয়ে যেত। তিনি বলেন, ‘এই সরকারের সব রকমের খেলা শেষ।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘এই সমাবেশের প্রস্তুতিসভার সময় শুনলাম পদ্মার এই পারে বিএনপিকে দাঁড়াতে দেবে না। বিএনপি তো দাঁড়িয়েই আছে। বিএনপিকে দাঁড়াতে দেবেন না, কিন্তু কিছুদিন পর সারা জীবন আপনাদেরও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’ তিনি সমাবেশে জমায়েত ঠেকাতে সরকারি দলের নানামুখী বাধার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের একটাই কথা ছিল, জনসভাকে সফল করতে হবে। তাদের পাতানো কোনো উসকানিতে আমরা পা দেব না। তাই আজকে এই জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘সরকারের ব্যর্থতার জন্য বিরোধী দল হরতাল ডেকে থাকে। কিন্তু আজকে বিনা ভোটের সরকার বিরোধী দলকে ঠেকাতে নিজেরাই হরতাল ডেকে বসে আছে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘এদের (আওয়ামী লীগ) চরিত্র হলো চুরি আর দুর্নীতি। এরা স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলে আরেক দেশে পালিয়ে যায়। এই দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী, অত্যাচারীদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। সংগ্রাম মাত্র শুরু, এর শেষ দেখেই ছাড়ব।’

খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলমের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান, অনিন্দ্য ইসলাম, সোহরাব হোসেন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, সুলতান সালাহউদ্দিন প্রমুখ। দলের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক খুলনা মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম (মঞ্জু) মিছিল নিয়ে সমাবেশে হাজির হলেও তাঁকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকালের খুলনার গণসমাবেশে বাধাবিপত্তির মাত্রা চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের সমাবেশের চেয়ে বেশি ছিল। তাই এ সমাবেশ নিয়ে এ অঞ্চলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবেগ ও উত্তেজনা ছিল বেশি। সমাবেশে অংশ নিতে এসে হামলার শিকার হয়ে আহত হওয়া ছাড়াও অনেক গল্প আছে নেতা-কর্মীদের। তেমনই এক গল্প জাহাঙ্গীর হোসেন শেখের। তাঁর বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নে। তিনি সে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি। সমাবেশে যোগ দিতে শুক্রবার দিনের বেলায় নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন, বাধার মুখে ফিরে যান। এরপর রাত আড়াইটায় তিনি লুঙ্গি পরে হাঁটা শুরু করেন। ৫৯ কিলোমিটার পথ হেঁটে খুলনা শহরে পৌঁছান গতকাল সকাল পৌনে আটটায়। সমাবেশ ঘিরে খুলনা বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমন সাড়াকেই বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।