ময়মনসিংহে নির্বাচন নির্দলীয়, বিভক্তি দলীয়

শহরে আলোচনা আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য যাঁকে সমর্থন দেবেন, তিনি সাবেক মেয়র ইকরামুলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন।

প্রতীক বরাদ্দের পর ময়মনসিংহ সিটি নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়েছে। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন পাঁচজন। এর মধ্যে সদ্য সাবেক মেয়র ইকরামুল হকসহ আওয়ামী লীগের নেতাই তিনজন। গত সংসদ নির্বাচনেও ময়মনসিংহ শহরের আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল। পুরোনো সেই বিরোধ সিটি নির্বাচনকে ঘিরে আবার প্রকাশ্যে এসেছে।

বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা না করায় এবার সিটি নির্বাচন অনেকটা ‘নির্দলীয়’ হতে যাচ্ছে। তবে নির্দলীয় এই নির্বাচনে নেতা-কর্মীদের আলোচনায় ঘুরেফিরে দলীয় বিভক্তির বিষয়টি বারবার সামনে আসছে।

আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। এই নির্বাচন নিয়ে ময়মনসিংহ মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১০ জন নেতার সঙ্গে গতকাল শুক্রবার কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, বিএনপি এই নির্বাচনে না থাকলেও দলের প্রভাবশালী তিন নেতা প্রার্থী হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান যাঁকে সমর্থন দেবেন, তিনিই ইকরামুলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন।

মেয়র পদে এখনো ইকরামুল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। তবে এবারের নির্বাচনে সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান বড় ‘ফ্যাক্টর’। তিনি প্রকাশ্যে কাউকে সমর্থন দিলে মাঠের চিত্র অনেকটাই বদলে যাবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আজাদ জাহান

মোহিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ইকরামুল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই দুজনকে ঘিরে নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বিভক্ত। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে মোহিত। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন ইকরামুলের বড় ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক। ইকরামুল নৌকার বিপক্ষে গিয়ে ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচন করেন। আমিনুল অল্প ভোটে মোহিতের কাছে হেরে যান। সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে মোহিত-ইকরামুল দ্বন্দ্ব আবার প্রকাশ্যে এসেছে।

মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশের মূল্যায়ন হচ্ছে, ময়মনসিংহ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে টানা ১২ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন ইকরামুল। ফলে স্থানীয়ভাবে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাঁর। সেই সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দলে তাঁর শক্ত অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে তাঁর বিরোধী পক্ষ মেয়র নির্বাচনে একক প্রার্থী দিতে পারেনি। দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় সুবিধা পাবেন ইকরামুল।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আজাদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র পদে এখনো ইকরামুল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। তবে এবারের নির্বাচনে সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান বড় ‘ফ্যাক্টর’। তিনি প্রকাশ্যে কাউকে সমর্থন দিলে মাঠের চিত্র অনেকটাই বদলে যাবে।

২০১৯ সালের ৫ মে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ৩৩টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ভোটে নির্বাচিত হলেও ইকরামুল হক মেয়র নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তবে এবারের নির্বাচন ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ দেখাতে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ।

গতকাল সকালে ময়মনসিংহ শহরের তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। ওই সময় মিলনায়তনের বাইরে হাজারো নেতা-কর্মী জড়ো হন। তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগের তিন মেয়র পদপ্রার্থীর অনুসারী নেতা-কর্মী ও সমর্থক। প্রতীক বরাদ্দ হয়ে যাওয়ার পরও ইকরামুল ও তাঁর অনুসারীরা মিলনায়তনের বাইরে দীর্ঘ সময় স্লোগান-মিছিল দেন। অন্য প্রার্থীরা নিজেদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে অনেকটা নীরবেই চলে যান।

মেয়র পদে লড়ছেন ইকরামুল হক (টেবিলঘড়ি প্রতীক), ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম (ঘোড়া প্রতীক), জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান (হাতি প্রতীক), জাতীয় পার্টির শহিদুল ইসলাম (লাঙ্গল প্রতীক) ও মো. রেজাউল হক (হরিণ প্রতীক)।

আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা তিনজনই যোগ্য ও অভিজ্ঞ। দলীয় মনোনয়ন না থাকায় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে তিনজনের পক্ষেই আছেন। এতে দলীয় কোনো নিষেধ নেই।
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন

সামনে এহতেশাম-সাদেকুল, পেছনে মোহিত

সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান এখনো প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেননি। তবে ভোটের তফসিল ঘোষণার পর ফেসবুকে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সদ্য সাবেক মেয়রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ‘নগরপিতা’নয়, ‘নগরসেবক’ খোঁজার বিষয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্টও দিয়েছেন তিনি।

এ নির্বাচনে ইকরামুল হকের পক্ষে আছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা তিনজনই যোগ্য ও অভিজ্ঞ। দলীয় মনোনয়ন না থাকায় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে তিনজনের পক্ষেই আছেন। এতে দলীয় কোনো নিষেধ নেই। মোহিত উর রহমানের সমর্থনের বিষয়ে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে পারেন না।

দলীয় সূত্র জানায়, মেয়র পদে ইকরামুল হক ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে থাকা চারজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। একজন বাছাইয়ে বাদ পড়েন। আরেকজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। এই চার মেয়র প্রার্থীকে নিয়েই সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান একাধিক বৈঠক করেন। সমঝোতার মাধ্যমে ইকরামুলের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি তিনি।

শামীম আশরাফ ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছেন। পোস্টারের ডিজাইন করতে গিয়ে শামীম কোনো ভুল করলে তার জন্য আইন ছিল। সেটি না হয়ে তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা দুঃখজনক।
ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ

ইকরামুল বাদে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের আলোচনার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ১৯ ফেব্রুয়ারি একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। মোহিত উর রহমান তাঁর ফেসবুকে সেদিন একাধিক ছবি দেন। তাঁর তোলা সেলফিতে ওই চার মেয়র প্রার্থীই উপস্থিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে রয়েছেন এহতেশামুল আলম ও সাদেকুল হক খান। দুজনের যেকোনো একজনকে মোহিত সমর্থন দিতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে।

সিটি নির্বাচন নিয়ে সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের বক্তব্য জানতে গতকাল কয়েক দফা তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।

শামীম আশরাফ ইস্যুতে চাপে ইকরামুল

ময়মনসিংহ শহরের যানজট, জলাবদ্ধতাসহ নাগরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন তরুণ কবি ও গ্রাফিক ডিজাইনার শামীম আশরাফ। গত বছর ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে নেমে খননকাজে অনিয়মের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ করে সারা দেশে আলোচিত হয়েছিলেন তিনি।

বেনামি পোস্টারের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন ও মেয়র ইকরামুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে ১৮ ফেব্রুয়ারি শহরের আঠারোবাড়ি বিল্ডিং এলাকায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘গ্রাফিতি’ থেকে শামীমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ২০ ফেব্রুয়ারি জামিন পান। সে দিনই তাঁর বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করেন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাঞ্চন কুমার নন্দী।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, শামীমকে গ্রেপ্তারের আগে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিনসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে গিয়ে আল আমিন শামীমের উদ্দেশে মেয়রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক পোস্টার কেন করেন, এর কারণ জানতে চান। সেখানে উপস্থিত হন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ইকরামুল হকের বড় ভাই আমিনুল হক। তিনিও শামীমকে প্রশ্ন করেন, কার হয়ে মেয়রের বিরুদ্ধে তিনি এসব পোস্টারের ডিজাইন (নকশা) করেন।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের নাগরিক সংগঠন ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, শামীম আশরাফ ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছেন। পোস্টারের ডিজাইন করতে গিয়ে শামীম কোনো ভুল করলে তার জন্য আইন ছিল। সেটি না হয়ে তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা দুঃখজনক।

শামীম আশরাফের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে ফেসবুকে ময়মনসিংহের অনেক কবি-লেখক নিন্দা জানান। বিশেষ করে ইকরামুলের ভাই আমিনুল হকের শামীমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে এভাবে জেরা করার বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরেও নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ইকরামুল হক চাপে আছেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে।