নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভোটের প্রচারে ‘ভূমিদস্যুতা’
নারায়ণগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বড়ালু গ্রামে গতকাল শনিবার সকালে একটি চায়ের দোকানে ভোট নিয়ে কথা বলছিলেন স্থানীয় লোকজন। আলোচনার বিষয়বস্তু রূপগঞ্জে (নারায়ণগঞ্জ-১) ভোট কেমন হবে। বিএনপি নেই, তারপরও কেন স্বস্তিতে নেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগেরই আরেক নেতা। হঠাৎ আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপির মহাসচিবও এখানে অন্যতম প্রার্থী।
চায়ের আড্ডায় এই ব্যক্তিদের কথাতেই উঠে এল, ভোটের প্রচারে বেশি আলোচনা ‘ভূমিদস্যুতা’ নিয়ে। প্রার্থীরা একে অন্যকে ‘ভূমিদস্যুদের’ সহযোগী হিসেবে প্রচার করছেন।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গতকাল বিকেলেও দাউদপুরে নির্বাচনী সমাবেশে বলেছেন, ‘ভূমিদস্যুদের অর্থের লোভে পড়ে কেউ ভুল করবেন না। এই ভূমিদস্যুরা রূপগঞ্জে পুতুল এমপি বানিয়ে রাখতে চায়। এখানকার জনগণকে পুতুলের মতো নাচাতে চায় একটি ভূমিদস্যু গ্রুপ।’
পাল্টা অভিযোগও আছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী (প্রতীক কেটলি) শাহজাহান ভূঁইয়ার। তিনি রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
বড়ালুর সেই চায়ের দোকানে যাঁরা আলোচনা করছিলেন, তাঁদের একজন আবদুর রশিদ। তাঁর বাড়ি পাশের মুড়াপাড়ায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অনেকের জমি আবাসন ব্যবসায়ীরা দখল করে নিয়েছেন। এখানে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প হয়েছে। অনেক এলাকায় নতুন করে আবাসন প্রকল্প করার চেষ্টা চলছে। তাই স্থানীয় নির্বাচন হোক আর জাতীয় নির্বাচন; প্রত্যেক ভোটে এখানে আবাসন ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁরা নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করার চেষ্টা করেন। এবার সংসদ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
গতকাল সরেজমিনে দুটি ইউনিয়ন ও দুটি পৌর এলাকায় ঘুরে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২০টি আবাসন কোম্পানির প্রকল্প রয়েছে। সরকারি বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্যোগেও একাধিক আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এসব প্রকল্পের জমি কেনার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করছে বেসরকারি আবাসন কোম্পানি বা তাদের প্রতিনিধিরা। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করা হচ্ছে, আবার জোরপূর্বক দখল করে নেওয়ার অভিযোগও আছে। তাই রূপগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভূমিদস্যু’ শব্দটি বহুল উচ্চারিত। তাই প্রার্থীরাও ভোটারদের কাছে টানতে ‘ভূমিদস্যুতার’ বিরুদ্ধে কথা বলছেন বেশি।
স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া একজন পৌরসভার মেয়র ও একজন ইউপি চেয়ারম্যান বড় একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে টাকা বিলি করেছেন, এমন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অপরদিকে আলোচিত একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীকে সমর্থন দিয়েছেন বলে জানা যায়। ওই ইউপি চেয়ারম্যানও একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিক।
‘ভূমিদস্যু’ ইস্যু নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী বিভিন্ন সময় শাহজাহান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গাজী গোলাম মূর্তজা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শাহজাহান ভূঁইয়াকে নির্বাচনে এনেছে ‘ভূমিদস্যুরা’। রূপগঞ্জে একজন ‘পুতুল’ সংসদ সদস্য বানাতেই শাহজাহান ভূঁইয়াকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে আনা হয়েছে।
তবে শাহজাহান ভূঁইয়া বলেছেন, তিনি ভূমিদস্যুদের হয়ে কাজ করেন, এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন গত তিনবারের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী। আর রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন শাহজাহান ভূঁইয়া।
এখানকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বড় অংশ গোলাম দস্তগীর গাজীর পক্ষে নেমেছেন। আরেক অংশ নেমেছেন শাহজাহান ভূঁইয়ার পক্ষে।
কাগজপত্রে এখানে মোট প্রার্থী ৯ জন। তবে গোলাম দস্তগীর ও শাহজাহান ভূঁইয়ার বাইরে ভোটের প্রচারে সক্রিয় আছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম।
সরেজমিনে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ভোটের মাঠে তৈমুর আলমকে নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনাও আছে। তাঁর পেছনেও কোনো না কোনো আবাসন কোম্পানির সহযোগিতা রয়েছে বলে প্রচার আছে। তবে তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, এটা তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। তিনি তৃণমূল বিএনপির হয়ে নির্বাচন করছেন, অন্য কারও হয়ে নয়।
প্রার্থীদের নিয়ে নানামুখী আলোচনা ও প্রচার-প্রচারণায় এলাকা সরগরম থাকলেও বিভিন্ন বয়সের ১০ জন ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেছেন, এর আগে কয়েকটি স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। তাই এবার ভোট দিতে যাবেন কি না, এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো দেখলে হয়তো ভোট দিতে যাবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।