পঙ্কজকে ঠেকাতে মরিয়া বিরোধীরা

বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ
ছবি: সংগৃহীত

মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৪ আসনটি স্থানীয় রাজনীতিতে সংঘাতপূর্ণ এলাকা হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের অনুসারী ও তাঁর দলীয় প্রতিপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এলাকাটিতে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

দুই পক্ষের রাজনৈতিক সংঘাতে নির্বাচনী আসনটিতে গত ৯ বছরে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেক নেতা-কর্মী।

পঙ্কজের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীকে বাদ দিয়ে তিনি তাঁর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। তিনি নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেন। এ নিয়েই তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

পঙ্কজের অনুসারীরা বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগের ইন্ধনে একটি পক্ষ তাঁকে ঠেকানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

পরস্পরকে কোণঠাসা করতে উভয় পক্ষ সব সময় মুখোমুখি অবস্থানে থাকছে। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সময় দুই পক্ষের সংঘাতে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

পক্ষ-বিপক্ষ

দলীয় সূত্রে জানা যায়, পঙ্কজের বিরোধী পক্ষে আছেন মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মইদুল ইসলাম ও বর্তমান সভাপতি কামাল খান। এই পক্ষ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহসহ তাঁর অনুসারী নেতাদের সমর্থন পেয়ে আসছেন।

পঙ্কজের পক্ষে আছেন মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, দলকে বিভক্ত করে এলাকায় নিজের বলয় সৃষ্টি করেছেন পঙ্কজ। তিনি নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, পঙ্গু করে দেওয়া, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছেন।

পঙ্কজ নাথ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে চাপে রাখতেই প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে।

পঙ্কজের উত্থান

পঙ্কজ গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হন।

আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০০৯ সালে ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন পঙ্কজ। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বে থাকাকালে তিনি ২০১৪ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন ২০১৮ সালে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়েই দলের বাইরে গিয়ে এলাকায় নিজস্ব বলয় তৈরিতে উদ্যোগী হন পঙ্কজ। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার সময় পঙ্কজ দুই উপজেলায় এই সংগঠনের নামে শক্তিশালী বলয় তৈরি করেন। এ অবস্থায় তাঁর বিরোধী পক্ষ জেলা আওয়ামী লীগের দ্বারস্থ হয়। তাদের সমর্থন দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ।

২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর পঙ্কজকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রকাশ্য বিরোধ

২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনের সময় দুই পক্ষের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। জেলা আওয়ামী লীগের সুপারিশে চেয়ারম্যান পদে বেশির ভাগ ইউনিয়নে মনোনয়ন পান পঙ্কজের বিরোধীরা। ইউনিয়নগুলোতে পঙ্কজের সমর্থনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন তাঁর অনুসারীরা। নির্বাচনে সহিংসতা ও রক্তপাত হয়েছিল।

একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সবশেষ ইউপি নির্বাচনেও। এই নির্বাচনে মেহেন্দীগঞ্জের ছয়টিতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হন। বিরোধীপক্ষের অভিযোগ, এসব ইউনিয়নে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের বিদ্রোহী হিসেবে দাঁড় করান পঙ্কজ। বর্তমানে ১২টি ইউপিতে তাঁর অনুসারীরা চেয়ারম্যান।

এ ছাড়া মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলা পরিষদের সবশেষ নির্বাচনে পঙ্কজ-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হন।

পঙ্কজের বিরোধী হিসেবে পরিচিত মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামাল খান বলেন, দল যাঁকেই মনোনয়ন দেয়,  তাঁকে সংসদ সদস্যের পছন্দ হয় না। দলের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

পঙ্কজ পক্ষের নেতা খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় বসে বাণিজ্য করে মনোনয়ন দিলেই তো আর তৃণমূল মেনে নেবে না। ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে না দিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ায় সমস্যার শুরু।

পঙ্কজ নাথ প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় মনোনয়নের পদ্ধতি অনুসরণ না করে তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে যাঁকে ইচ্ছা তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। মনোনয়ন বাণিজ্যের পাশাপাশি তাঁকে চাপে রাখতেই এমনটা করা হয়। তৃণমূল মেনে নিতে না পেরে মনোনয়নের বিরোধিতা করে। এর দায় তাঁর কাঁধে এসে পরে।

সংঘাত-সংঘর্ষ

গত জুলাইয়ে পঙ্কজের একটি মুঠোফোন কল রেকর্ড ভাইরাল হয়। সেখানে পঙ্কজকে মেহেন্দীগঞ্জ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার কর্মীদের বলে দিয়েছি, রামদা নিয়ে রেডি থাকতে। সামনে যাঁকে পাওয়া যাবে, তাঁকেই কোপানো হবে। মেয়রকে (কামাল) পেলেও কোপানো হবে।’

আরও পড়ুন

গত ২৮ আগস্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢুকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী নেতা-কর্মীদের মারধর ও কুপিয়ে জখম করা হয়। হামলায় জড়িত ব্যক্তিরা পঙ্কজের অনুসারী বলে অভিযোগ করা হয়।

মেহেন্দীগঞ্জের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের চারজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, মেহেন্দীগঞ্জের রাজনীতি অনেক সহিংস হয়ে উঠেছে। এত সহিংসতা আগে দেখা যায়নি। দলীয় বিরোধ থেকে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে। হামলা-মামলা চলছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ছায়া কমিটি রয়েছে।

পঙ্কজ-বিরোধীদের অভিযোগ, এই সংসদ সদস্য নিজের লোক দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তাঁর বিরোধী নেতা-কর্মীদের হামলা, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

অবশ্য পঙ্কজের অনুসারী নেতা-কর্মীরা মনে করেন, এই সংসদ সদস্য স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।

আরও পড়ুন

পঙ্কজকে ঠেকাতে মরিয়া

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত ১১ সেপ্টেম্বর পঙ্কজকে আওয়ামী লীগের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

এর আগে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ থেকে পঙ্কজ নাথকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করে কেন্দ্রে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এতে অভিযোগ করা হয়, পঙ্কজ নাথ দলের মধ্যে বিভেদ ও নিজের বলয় তৈরি করছেন। তিনি পুরোনো ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোণঠাসা করে রেখেছেন। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়া, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করতে খুনখারাবি, দলীয় নেতা-কর্মীদের মারধর, কুপিয়ে জখম, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অপমান-অপদস্থ করছেন।

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল খান বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের ৮১ সদস্যের কমিটির মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ জন পঙ্কজের সঙ্গে আছেন। সংগঠনের সিংহভাগ নেতা-কর্মী তাঁর সঙ্গে নেই। দল অব্যাহতি দেওয়ার পর পঙ্কজ ও তাঁর অনুসারীদের দাপট একটু কমেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে না বলেই তৃণমূলের প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন

খোরশেদ আলম বলেন, গত ৫০ বছরে মেহেন্দীগঞ্জে যে উন্নয়ন হয়নি, তা পঙ্কজের সময় হয়েছে। তিনি এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতা খেয়ে না খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছেন। তাঁদের সঙ্গে জেলার কিছু নেতা আছেন। তাঁদের একটাই চাওয়া—পঙ্কজকে ঠেকানো। তবে মেহেন্দীগঞ্জে পঙ্কজের বিকল্প নেই। তাঁকে মনোনয়ন না দিলে এই আসন আওয়ামী লীগ ধরে রাখতে পারবে না।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ পঙ্কজের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। তারা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ক্যাডার দিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করেছিল। এবার তারা পঙ্কজকে ঠেকাতে আগেভাগেই মাঠে নেমেছে। পঙ্কজ-বিরোধী সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।