২০ দল ভেঙে দুটি জোট, লক্ষ্য যুগপৎ আন্দোলন 

নতুন দুটি জোট হলো ‘১২–দলীয় জোট’ এবং ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’। আলাদা থাকল বিএনপি, জামায়াত, এলডিপি।

২০–দলীয় জোটের বৈঠক
ফাইল ছবি

সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে ২০-দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দিয়েছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে বলে দেওয়া হয়, এখন থেকে কেউ যেন ২০-দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। এর উদ্দেশ্য, দলগুলো যাতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে জোটবদ্ধ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে জামায়াতনির্ভরতা কাটানো এবং রাজনীতিতে ‘বিএনপি-জামায়াত’ নামে যে নেতিবাচক প্রচার রয়েছে, সেটি কাটানোও এর অন্যতম লক্ষ্য। তারই অংশ হিসেবে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সক্রিয় করেনি। সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর ২০–দলীয় জোটকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কার্যত ভেঙে দেওয়া হয়।

যারা জোট গঠন করছে, তারা কিন্তু দলগতভাবে আমাদের ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি

কোনো না কোনোভাবে ২০-দলীয় জোটে ছিল এমন ১২টি দল মিলে ‘১২–দলীয় জোট’ গঠিত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে এর আত্মপ্রকাশ হবে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এককভাবে কর্মসূচি পালন করবে। এর বাইরে আরও ছয়টি দল মিলে ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ গঠন করা হচ্ছে।

সাবেক ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান অনানুষ্ঠানিক সভা ডাকেন। সভায় তিনি শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের জানিয়ে দেন, এখন থেকে কেউ যেন ২০-দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। তার আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনসহ বিএনপির তৈরি করা ১০ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র ‘মেরামতের’ ২৭ দফা রূপরেখার সারবস্তু তুলে ধরা হয়। সভায় এসব দাবি ও রূপরেখা সামনে রেখে সামনের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচিতে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

এক দশক আগে ২০১২ সালে ২০ দলীয় জোট গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন এই জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে হঠাৎ করে অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়ার ঘোষণায় শরিক দলগুলোর অনেকে হতাশা প্রকাশ করে। আবার কেউ কেউ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও জানান। সভায় উপস্থিত থাকা একজন নেতা প্রথম আলোকে জানান, নজরুল ইসলাম খান এসব প্রতিক্রিয়ায় কোনো জবাব না দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। 

এরপরই মূলত ছোট দলগুলো নিজেরা বৈঠক করে আলাদা জোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হতে তাদের সুবিধা হয়। তারই অংশ হিসেবে আজ ‘১২–দলীয় জোট’-এর আত্মপ্রকাশ হচ্ছে। দলগুলো হলো মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাফর), সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফিজুর রহমানের বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের বাংলাদেশ এলডিপি, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, নুরুল ইসলামের বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, আবুল কাসেমের বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, তাসমিয়া প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। 

জানা গেছে, এই জোটের নেতৃত্বে থাকবেন সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার। মুখপাত্র হিসেবে থাকবেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। গণমাধ্যম বিষয়ে সমন্বয় করবেন শাহাদাত হোসেন।

 শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে জানান, এ মুহূর্তে ছোট দলগুলোর জোটভুক্ত হওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। আর সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘২০-দলীয় জোট আর ফাংশনাল (কার্যকর) নয়। আমাদের সবাইকে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছে, ২০ দলের নাম আর ব্যবহার না করতে। সে কারণে আমরা ১২টি দল নতুন জোট গঠন করেছি। আমাদের সক্ষমতা সীমিত। তাই যুগপৎ আন্দোলন আমরা যদি সম্মিলিতভাবে করি, তাহলে ভালো হওয়ার কথা।’

জানা গেছে, ১২–দলীয় জোটের পর প্রথম পর্যায়ে ছয়টি দল নিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ গঠন করা হচ্ছে। এর নেতৃত্বে থাকছেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। এই জোটে আরও থাকছেন সাইফুদ্দীন মনির ডেমোক্রেটিক লীগ (ডিএল), খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) একাংশ, সাদেক শাওনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, আজহারুল ইসলামের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) ও গরীবে নেওয়াজের বাংলাদেশ পিপলস লীগ।

ফরিদুজ্জামান ফরহাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২–দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশের পর আমরা “জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট” ঘোষণা করব।’

জানা গেছে, ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ভাগাভাগি হয়ে আলাদা জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিএনপির সায় আছে। এর কারণ, যেহেতু বিএনপি কৌশলগত কারণে ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আর কার্যকর রাখছে না, তাতে ছোট দলগুলো একা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমমনা এতগুলো ছোট দলের সঙ্গে বিএনপির পক্ষে আলাদা বৈঠক করা বা যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়ে সমন্বয় করাও কঠিন হবে। বরং দলগুলো পৃথক জোটভুক্ত হলে তাদের সঙ্গে বিএনপির সমন্বয় করা সহজ হবে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকটি শরিক দলসহ বাম প্রগতিশীল ধারার মোট সাতটি দল নিয়ে ইতিমধ্যে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠন হয়েছে। এই গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সমন্বয়ের জন্যও লিয়াজোঁ (সমন্বয়) কমিটি হচ্ছে।

সমমনা বিভিন্ন দলের নতুন জোট গঠনকে ‘ইতিবাচক’ মনে করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা জোট গঠন করছে, তারা কিন্তু দলগতভাবে আমাদের ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যেহেতু ২০-দলীয় জোট আনুষ্ঠানিকভাবে নেই, তাই সমমনা দলগুলো নিজেরা জোট করছে, ভবিষ্যতে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।’

যদিও বিএনপির দীর্ঘদিনের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী কোনো জোটে নেই। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও (জামায়াত) অন্যান্য জোট, দল—বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। ইতিমধ্যে জামায়াত ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছে। আগামী ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিতেও একাত্মতা ঘোষণা করা হয়েছে। এই কর্মসূচি কীভাবে পালন হয়, সে ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করা হবে।’

বিএনপির আরেক মিত্র অলি আহমেদের এলডিপিও কোনো জোটে নেই। এলডিপির সভাপতি অলি আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা অন্য কোনো দলের সহযোগিতা ছাড়া যুগপৎ কর্মসূচি পালন করতে সক্ষম। সে কারণে আমরা অন্য কোনো দলের সঙ্গে যাইনি।’