শান্তিপূর্ণ ভোটের প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের

  • নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের গুজবে কান না দিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান।

  • বিভিন্ন প্যানেলের ইশতেহারে গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির স্থায়ী অবসানের প্রতিশ্রুতি।

ডাকসু নির্বাচনে প্রচার–প্রচারণার শেষ দিন ছিল গতকাল। উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল ক্যাম্পাসজুড়ে। রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরেপ্রথম আলো

শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর প্রচার চলেছে গত ১৩ দিন। এই সময়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রার্থীরা। তাঁরা আরও বলেছেন, সব সময় শিক্ষার্থীদের পাশে থাকবেন। ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনকে ঘিরে সৌহার্দ্য–সম্প্রীতির এমন পরিবেশ ভোট গ্রহণ থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত বজায় থাকুক, এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে গতকাল রোববার। গত ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হয় প্রচার। ভোট গ্রহণ করা হবে আগামীকাল মঙ্গলবার।

ভোটের প্রচারের শেষ দিনে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শপথ পাঠ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছাত্রদলের প্যানেল। সেখানে ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছাত্রদলের প্রার্থীরা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ১৮টি হল সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সংগঠনটির প্রার্থীরাও। সব মিলিয়ে ছাত্রদলের ২০৫ জন প্রার্থী আটটি বিষয়ে শপথ নেন। শপথ পাঠ করান ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান।

ডাকসুতে নির্বাচিত হলে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আচরণে গণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটানোর শপথ নিয়েছেন ছাত্রদলের প্রার্থীরা। শপথের প্রথম দফায় বলা হয়, ফ্যাসিবাদী শাসনামলের ঘৃণিত গণরুম প্রথা, গেস্টরুম নির্যাতন, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য বাধ্য করানো, ভিন্নমতের জন্য অত্যাচার-নিপীড়ন চালানোর যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে তা আর কখনো ফিরে আসতে দেওয়া হবে না।

প্রচারের শেষ দিনে গতকাল দুপুরে হুইলচেয়ারে করে মধুর ক্যানটিনের সামনে নিজ প্যানেলের সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। তিনি হাসপাতাল থেকে সরাসরি ক্যাম্পাসে আসেন। বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠন সমর্থিত প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু সব ভোটারকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা ভোট দিতে এলে এখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা পোস্টেও জিতে আসতে পারবে না।’

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ-সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ গতকাল বিকেলে মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের বলেন, যাঁরা খাওয়াচ্ছেন বা টাকা খরচ করছেন, তাঁদের দেখে শিক্ষার্থীরা যেন প্রভাবিত না হন। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বাংলাদেশের বিবেক। আপনার ভোট আপনার বিবেক দিয়ে দিন। কে অতীতে আপনার জন্য লড়েছে, কে আপনার সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়েছে, তা দেখে সিদ্ধান্ত নিন।’

ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থীরা গতকাল ক্যাম্পাসে প্রচারপত্র বিলি করেছে। রাত ১০টার দিকে মধুর ক্যানটিনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। সেখানে এই প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, সব দল–মতের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁরা স্বপ্নের ক্যাম্পাস গড়তে চান।

ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে বুথ তৈরি করা হচ্ছে। টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

অন্যদিকে উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থীরাও গতকাল সকাল থেকে প্রচার চালিয়েছেন। আর প্রচারের শেষ দিনে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে বামপন্থী তিনটি ছাত্রসংগঠন সমর্থিত প্যানেল ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’। মিছিল করেছেন আরও একটি প্যানেলের প্রার্থীরা।

এ ছাড়া গতকাল বিকেলে ক্যাম্পাসের কলাভবনের সামনে ঐতিহাসিক বটতলায় ‘ডাকসু প্রার্থীদের ভাবনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তির লড়াই’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যত বড় বড় অর্জন সেটা পানি পান করিয়ে, লাইব্রেরিতে বই দিয়ে বা ডাইনিংয়ের খাবারের মান উন্নত করে আসেনি। এসেছে সমাজের মুক্তির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে।

একই অনুষ্ঠানে ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্রসংগঠন অতীতে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছে, শিক্ষার্থীরা তাদের গ্রহণ করেনি।

আচরণবিধি

প্রচারের ক্ষেত্রে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রার্থীরা ভোটারদের কোনো ধরনের উপঢৌকন বা বকশিশ দিতে পারবেন না। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভোটারদের জন্য পানীয় বা খাদ্য পরিবেশন করা যাবে না। তবে কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা, বিশেষ করে কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের আশপাশের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দুপুর ও রাতের খাবার খাইয়েছেন, এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে আছে। অবশ্য এ নিয়ে কেউ নির্বাচন কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ করেননি।

এবারের ডাকসু নির্বাচন ঘিরে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি উঠেছে। এসব ঘটনায় বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সহযোগিতা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। একজন নারী প্রার্থীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলবদ্ধ ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আলী হুসেনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

প্রস্তুত ব্যালট বাক্স, পাঠানো হবে কেন্দ্রে। সিনেট ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৭ সেপ্টেম্বর
ছবি: দীপু মালাকার

প্রচারের শেষ দিকে এসে একটি অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে ভোট চাইছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ বেশি এসেছে ছাত্রদল ও বিএনপির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে কয়েকজন ছাত্রী ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের মুঠোফোন নম্বর বাইরের লোকদের হাতে তুলে দিয়েছে কি না। তবে নির্বাচন কমিশন গতকাল এক ব্রিফিংয়ে বলেছে, তারা কাউকে শিক্ষার্থীদের তথ্য সরবরাহ করেনি।

প্রচারের শেষ দিনে গতকাল দুজন শিক্ষক ও ১২ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। ডাকসু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেই প্রত্যাশা রেখে তাঁরা বলেন, এই নির্বাচন নিয়মিত হতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পরিবর্তন আসবে। দখলদারত্ব, নির্যাতন–নিপীড়ন ও পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতিকে চিরতরে বিদায় করতে হলে এর বিকল্প নেই।

ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি

ডাকসু নির্বাচনে জিতলে শিক্ষার্থীদের জন্য কী কী করবে, তা ইশতেহার আকারে প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্যানেলগুলো। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ব্যক্তিরাও আলাদাভাবে ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। এসব ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম–গেস্টরুম সংস্কৃতির স্থায়ী অবসানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আবাসন, খাদ্য ও পরিবহন সমস্যার সমাধান, রেজিস্ট্রার ভবনে ভোগান্তির অবসানের জন্য ডিজিটালাইজেশন, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রার্থীরা।

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ১০ দফা ইশতেহার প্রকাশ করেছে। এর প্রথম দফায় শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক, আনন্দময় ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দমন-পীড়নের মতো ঘৃণিত চর্চা বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ছাত্রদল। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে কাজ করার কথাও বলেছে তারা।

শিবিরের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ৩৬ দফা ইশতেহার দিয়েছে। তাদের প্রথম দফা হলো ডাকসু নির্বাচনকে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করা। তাদের দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি—ক্যাম্পাসকে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করা। শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করার কথাও বলেছে তারা।

আট দফার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা এবং ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে প্রথম অগ্রাধিকারে রেখেছে তারা। এ ছাড়া আবাসিক হলে গেস্টরুম-গণরুম সংস্কৃতি চিরতরে মুছে ফেলার অঙ্গীকার করেছে তারা। নারীদের জন্য বিশেষ সাইবার নিরাপত্তা সেল গঠন ও আইনি সহায়তা দেওয়া, ‘ওয়ান কার্ড অল সার্ভিস’-এর মাধ্যমে পাঠাগারসুবিধা, স্বাস্থ্য ও পরিবহনসেবাসহ বেশ কিছু বিষয় তাদের ইশতেহারে রয়েছে।

১১ দফা ইশতেহার দিয়েছে উমামা ফাতেমার ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল। শতভাগ আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায্য বেতনে পার্টটাইম (খণ্ডকালীন) চাকরির সুযোগ তৈরি করা এবং নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এই প্যানেল।

বামপন্থী সাত সংগঠনের প্রতিরোধ পর্ষদ ১৮ দফা ইশতেহার দিয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণায় অগ্রাধিকার, সব হলে সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ করা, নারীবান্ধব ক্যাম্পাস, হলগুলোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যানটিনের পরিবর্তে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ক্যাফেটেরিয়া চালু করার কথা বলেছে তারা।

আগামীকাল মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে। ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৪৭১ জন। আর ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হবে ১৩টি করে পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ১ হাজার ৩৫ জন শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গতকাল বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, গুজব একটি সামাজিক ব্যাধি। কোনো ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু চারদিকে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের গুজব হতে পারে—অমুক প্রার্থী চলে গেছে, অমুক প্রার্থী আরেকজনকে সমর্থন করছে। তাই ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।