তারেক রহমান ফিরছেন আজ, বিএনপির নতুন করে পথচলার সংকল্প
তারেক রহমান কবে দেশে আসবেন—গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এটি ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। আজ ২৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সেই দিন। সব আলোচনার অবসান ঘটিয়ে তাঁর আজ বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ঢাকায় অবতরণের কথা রয়েছে। গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া ১২টা) তাঁকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে। এই প্রত্যাবর্তন দলের নেতা-কর্মীদের কাছে শুধু একটি আগমন নয়; তাঁদের জন্য এটি ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে আসার গল্প, নতুন রাজনীতি ও নতুন করে পথচলার সংকল্প।
১৭ বছর আগে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনে যান, তখন তিনি ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা। মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে এক মাসের বেশি সময় ধরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দলের নেতা-কর্মীদের কাছে শুধু একটি আগমন নয়; তাঁদের জন্য এটি ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে আসার গল্প, নতুন রাজনীতি ও নতুন করে পথচলার সংকল্প।
মায়ের অসুস্থতায় কার্যত ছেলেই প্রধান নেতা হিসেবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কার্যত তাঁর নেতৃত্বেই অংশ নিচ্ছে। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দলের নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশা, তাঁর ফেরার মধ্য দিয়ে সারা দেশে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষের পক্ষে নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হবে।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না। রাজনীতির এমন পটভূমিতে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী সমমনা আটদলীয় জোট। এমন পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের দেশে ফেরা বিএনপির কৌশল ও মাঠের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। সে জন্য আজ ঢাকায় তারেক রহমানকে অভ্যর্থনা জানাতে বিপুল জনসমাগমের প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকায় গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছে বিএনপি। কুড়িল মোড়সংলগ্ন সড়কের উত্তর পাশে দক্ষিণমুখী করে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ৪৮ ফুট বাই ৩৬ ফুটের বিশাল মঞ্চ। মঞ্চের দুই পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাঁবু বসানো হয়েছে এবং ল্যাম্পপোস্টে মাইক স্থাপন করা হয়েছে। কুড়িল থেকে সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ‘তারেক রহমানকে স্বাগত’ জানিয়ে বিভিন্ন রঙের ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে।
মায়ের অসুস্থতায় কার্যত ছেলেই প্রধান নেতা হিসেবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কার্যত তাঁর নেতৃত্বেই অংশ নিচ্ছে। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রথম তিন দিনে তারেক রহমান যা করবেন
তারেক রহমানের ফেরার পর তাঁর কর্মসূচি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে গতকাল বুধবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
সংবাদ সম্মেলনে সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নিয়মিত ফ্লাইটে বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে সিলেটে যাত্রাবিরতির পর বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন তারেক রহমান। বিমানবন্দরের রেড জোনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি ৩০০ ফুট সড়কে বিএনপি আয়োজিত সংক্ষিপ্ত গণসংবর্ধনা সমাবেশে যোগ দেবেন। ওই সমাবেশে শুধু তারেক রহমানই বক্তব্য দেবেন। সমাবেশ শেষে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে তাঁর মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সেখান থেকে তিনি যাবেন গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায়। এ বাসায় তিনি থাকবেন।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকায় গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছে বিএনপি। কুড়িল মোড়সংলগ্ন সড়কের উত্তর পাশে দক্ষিণমুখী করে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ৪৮ ফুট বাই ৩৬ ফুটের বিশাল মঞ্চ। মঞ্চের দুই পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তাঁবু বসানো হয়েছে এবং ল্যাম্পপোস্টে মাইক স্থাপন করা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান হবে। সেখানে তিনি দেশবাসীর প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করবেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, পরদিন ২৬ ডিসেম্বর বাদ জুমা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করবেন তারেক রহমান। ওই দিন তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। ২৭ ডিসেম্বর তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার নিবন্ধন-সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। এ ছাড়া শরিফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করবেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচিও রয়েছে।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে দলীয় ও সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) চাওয়া হয়নি বলে স্পষ্ট করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
সম্ভাব্য জনসমাগম বিবেচনায় বিমানবন্দর, ৩০০ ফুট সড়ক, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে ২০টি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। মূল মঞ্চের কাছে থাকবে ছয় শয্যার মেডিকেল ক্যাম্প, আইসিইউ সুবিধাসহ অ্যাম্বুলেন্স।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে। পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) চাওয়া হয়নি বলে স্পষ্ট করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
সংবর্ধনা মঞ্চ ঘিরে লাখো মানুষ
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘিরে কয়েক দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেন। নিজ উদ্যোগে বাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে হাতে বাংলাদেশ ও বিএনপির পতাকা নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেন তাঁরা।
সরেজমিনে সংবর্ধনা মঞ্চ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী–সমর্থক খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হচ্ছেন। কেউ বাসে, কেউ ট্রাকে, কেউ লঞ্চে—হাতে পতাকা, কণ্ঠে স্লোগান। অনেকে ফেসবুক লাইভ করছেন, আবার অনেকে ‘মা-মাটি ডাকছে, তারেক রহমান আসছে’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে, আসবে এবার বাংলাদেশে’—এমন স্লোগানে এলাকা মুখর করে তুলছেন। সেখানে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সের (সিএসএফ) সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
সংবর্ধনা মঞ্চের সামনে কথা হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ছাত্রদলের সহসভাপতি ফেরদৌস নাভিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে থাকবে ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভোটের অধিকার ও জনগণের শাসন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের অপেক্ষায় আমরা সবাই।’
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে ঢাকায় এসেছি।’
সরেজমিনে সংবর্ধনা মঞ্চ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী–সমর্থক খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হচ্ছেন। কেউ বাসে, কেউ ট্রাকে, কেউ লঞ্চে—হাতে পতাকা, কণ্ঠে স্লোগান। অনেকে ফেসবুক লাইভ করছেন, আবার অনেকে ‘মা-মাটি ডাকছে, তারেক রহমান আসছে’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে, আসবে এবার বাংলাদেশে’—এমন স্লোগানে এলাকা মুখর করে তুলছেন।
নির্বাসনের দীর্ঘ অধ্যায়
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির মামলায় আটক হয়ে প্রায় ১৮ মাস কারাবন্দী ছিলেন তারেক রহমান। মুক্তি পাওয়ার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডনে যান। এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি সেখানেই অবস্থান করেন।
তারেক রহমান আজ ফিরছেন এমন এক সময়ে, যখন রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। ভোটের মাঠ তৈরি হচ্ছে, আর বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে পুনর্জাগরণের। দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন শুধু দলীয় রাজনীতির জন্য নয়, সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাঁদের বিশ্বাস, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির রাজনীতিতে নতুন গতি এনে দেবে। নির্বাচন সামনে রেখে তাঁর দেশে ফেরা দলকে আরও দৃঢ়ভাবে দাঁড় করাবে।
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের সংবর্ধনা, তারপর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মা খালেদা জিয়াকে দেখা—এই যাত্রাপথ যেন রাজনীতি ও ব্যক্তিগত জীবনের দুই বাস্তবতা এক সুতায় গাঁথা। মায়ের শয্যাপাশে ছেলের ফিরে আসা, আর একই দিনে দলের লাখ লাখ কর্মীর ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার মুহূর্ত আবেগ ছড়াচ্ছে দলীয় অঙ্গনে।