নির্বাচনে ক্রাউডফান্ডিং কী? এতে কি আচরণবিধির লঙ্ঘন হচ্ছে?

প্রতীকী ছবি

‘জীবনে প্রথম কোনো রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনে সরাসরি টাকা দিলাম। কিন্তু এটা কোনো দলকে নয়, একজন ব্যক্তিকে।’— সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি পোস্ট করেছেন মাহমুদুল হাসান নামের একজন, সঙ্গে যুক্ত রয়েছে টাকা পাঠানোর একটি ডিজিটাল রসিদের ছবি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের এবার সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনী ব্যয় মেটানোর জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে দেখা যাচ্ছে। জনগণের কাছে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে এই দৃশ্য এখনো নতুন। তবে শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এমন গণচাঁদা তোলার রেওয়াজ রয়েছে।

তহবিল সংগ্রহের এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে ‘ক্রাউডফান্ডিং’ (গণতহবিল)। তবে ক্রাউডফান্ডিং করতে গিয়ে প্রার্থীরা নিজেদের প্রচার চালিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ক্রাউডফান্ডিং কী

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মাধ্যম ইনভেস্টোপিডিয়ার তথ্য বলছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন কোনো ব্যবসা বা উদ্যোগ শুরু করতে তহবিলের জন্য অল্প পরিমাণ করে অর্থ প্রদান করে, সেটাকে ক্রাউডফান্ডিং বা গণতহবিল বলা হয়। সাধারণত এই অর্থ ফেরত দিতে হয় না। গণতহবিল মূলত স্টার্টআপ বা নতুন কোনো ব্যবসা উদ্যোগের জন্য বিকল্প তহবিলের জোগানের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মূলত ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর এই অর্থায়ন পদ্ধতি বেশি গুরুত্ব পায়। সে সময় ব্যাংকঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় ছোট ও নতুন ব্যবসাগুলো বিকল্প অর্থের উৎস খুঁজতে শুরু করে। ক্রাউডফান্ডিং তখন সেই বিকল্প পথ হিসেবে সামনে আসে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ক্রাউডফান্ডিং বাজার দ্রুত বাড়ছে। গ্লোবাল ইকুইটি ক্রাউডফান্ডিং অ্যালায়েন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে এই খাতের প্রবৃদ্ধি হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।

ক্রাউডফান্ডিংয়ের নিকট উদাহরণ রয়েছে ভারতবর্ষেই। এক শ বছরেরও বেশি সময় আগে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’ গঠন করেছিলেন। তবে সফল ক্রাউডফান্ডিংয়ের তথ্য পাওয়া যায় ফান্ডেবলডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, ক্রাউডফান্ডিংয়ের প্রথম সফল ঘটনা ঘটে ১৯৯৭ সালে। ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ম্যারিলিওন তাদের পুনর্মিলনী সফর আয়োজনের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে অনলাইনে অনুদান নিয়েছিল। তাদের এই পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০১ সালে আর্টিস্টশেয়ার নামের প্রথম ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম গড়ে ওঠে, যারা শিল্পীদের অ্যালবাম তৈরি করতে বা সফরে (ট্যুর) যেতে অর্থ সংগ্রহ করে দেয়।

এক শ বছরেরও বেশি সময় আগে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে ‘তিলক স্বরাজ তহবিল’ গঠনের খবর সংবাদপত্রে।

দেশে দেশে রাজনৈতিক ক্রাউডফান্ডিং

রাজনৈতিক গণতহবিলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, রাজনীতিবিদদের সরাসরি দাতাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করা। সম্ভাব্য সমর্থকদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতের বামপন্থী দলগুলো প্রথমে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আদায় করত। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে এই পথে হাঁটতে শুরু করে দেশটির প্রাচীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। দলটি এই অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘ডোনেট ফর দেশ’ বা দেশের জন্য দান।

দেশটির রাজনীতিকদের গণতহবিল সংগ্রহের উদাহরণ রয়েছে। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের আম আদমি পার্টির নেত্রী ও দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতিশী মার্লেনা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দলের প্রচারণার খরচ মেটাতে একটি গণতহবিলের প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তাঁর নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য ৪০ লাখ রুপি দরকার ছিল।

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার ৬৯ শতাংশ তহবিল ক্ষুদ্র দাতাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

বাংলাদেশে ক্রাউডফান্ডিং

সাধারণত রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গণচাঁদা সংগ্রহ করেই চলে। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন রাজনীতিবিদেরা কোনো বড় গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নেন এবং তাঁদের স্বার্থে কাজ করেন। এই অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলো গোপনে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশে গণচাঁদার ইতিহাস পুরোনো হলেও ক্রাউডফান্ডিং এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তরুণ রাজনীতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই উদ্যোগ নিয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টাকা নেওয়া হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে। তবে এটি এখনো নির্বাচনী অর্থায়নের মূলধারা নয়।

এনসিপির নেত্রী তাসনিম জারা, ক্রাউডফান্ডিংয়ে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন তিনি
ছবি; তাসনিম জারার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, নতুন নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাই ক্রাউডফান্ডিং করছেন। তাঁরা বলছেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চান। যার টাকা আছে, সে সংসদে যেতে পারবে, নীতিনির্ধারক হতে পারবে—এমন রীতির পরিবর্তন চান।

ক্রাউডফান্ডিংয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেত্রী তাসনিম জারা। ঢাকা-৯ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে যাচ্ছেন তিনি। গত বুধবার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি জানান, ২৯ ঘণ্টায় তাঁকে ৪৭ লাখ টাকা নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য দিয়েছেন মানুষ।  

আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন

সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫ এর বিধি ১৮–তে বলা হয়েছে, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা দলের মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের ৩ সপ্তাহের আগে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না। আর ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচারণা শেষ করতে হবে।

তাহলে বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে প্রার্থীদের ক্রাউডফান্ডিং করা নির্বাচনী প্রচারণার নতুন কৌশল কি না, তা জানতে চাওয়া হয় দুজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞের কাছে। তাঁরা বলছেন, এটি প্রচারণার কৌশল হতে পারে। তবে আইন অনুযায়ী বাধা দেওয়ারও সুযোগ নেই।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এর আগে কখনো ক্রাউডফান্ডিংয়ে বিষয়টি দেখা যায়নি। ফলে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে।  

স্বচ্ছতা রাখার তাগিদ

যুক্তরাজ্যের দ্য ইলেকটোরাল কমিশন দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অর্থায়নের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা একটি স্বাধীন সংস্থা। তাদের ওয়েবসাইটে গণতহবিলের স্বচ্ছতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, গণতহবিলের সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকতে হবে যে অর্থ কাকে দান করা হচ্ছে এবং কী জন্য দান করা হচ্ছে। অর্থাৎ তহবিলটি রাজনৈতিক দলের কাছে যাচ্ছে কি না, নাকি প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় মেটাতে নেওয়া হচ্ছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) অনুচ্ছেদ ৪৪-এ নতুন সংযোজন অনুসারে, প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, প্রার্থীর সম্ভাব্য আয়ের উৎস তাঁকে দেখাতে হবে। কোনো অনুদান পেলে সেটির সঠিক তথ্য থাকতে হবে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ক্রাউডফান্ডিং একটি নতুন প্রচেষ্টা। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কালো টাকার প্রভাব–প্রতিপত্তিমুক্ত করার একটা ইতিবাচক দিক হতে পারে এটি। তবে যাঁরা ক্রাউডফান্ডিং করছেন অবশ্যই তাঁদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। আয় এবং ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে।