নিরুত্তাপ ভোটে জয়ী খালেক

তালুকদার আবদুল খালেক, খুলনা সিটি নির্বাচনে বিজয়ের পর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ভোটের মাঠে ছিল না ক্ষমতাসীন দলটির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিও। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা নিরুত্তাপ প্রচারের সময় ধারণা করা হয়েছিল, তালুকদার খালেকই জয়ী হতে যাচ্ছেন। সেটাই হয়েছে, গতকাল সোমবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি জয়ী হয়েছেন। এ নিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো খুলনার নগরপিতা হলেন।

নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেয়র পদে তালুকদার খালেক পেয়েছেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য চার প্রার্থীর কেউই তাঁর কাছাকাছি ভোট পাননি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা আবদুল আউয়াল পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট, জাতীয় পার্টির শফিকুল ইসলাম ১৮ হাজার ৭৪ ভোট, জাকের পার্টির এস এম সাব্বির হোসেন ৬ হাজার ৯৬ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান পেয়েছে ১৭ হাজার ২১৮ ভোট। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচনে স্মার্ট কারচুপির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে।

এবার নির্বাচনে ভোট পড়েছে বিগত নির্বাচনের চেয়েও কম। এবার ভোটের হার ছিল ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

যদিও সকাল সোয়া ৯টার দিকে নগরীর গগনবাবু সড়ক এলাকার পাইওনিয়ার বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ভোট দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর অনুমান ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে আসবেন।

খুলনা সিটিতে সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৬২ দশমিক ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলেও নানা মহল থেকে বলা হয়েছিল। এমন অভিযোগ এনে ভোট শুরুর তিন ঘণ্টার মাথায় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে এবারের নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না।

সরেজমিনে প্রথম আলোর চারজন প্রতিবেদক ও দুজন আলোকচিত্রী গতকাল দিনভর ১৫টি ওয়ার্ডের ৩৩টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। তাঁরা জানান, এসব কেন্দ্রে দিনভর কোনো সহিংসতা, হামলা বা কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।

অনেক ভোটারকে ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বি কে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আবুল বাশার বলেন, ‘গত কয়েকবার ভোট দিতে পারিনি। কেন্দ্রে এসে শুনি আমার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এবার ভোট দিতে কোনো সমস্যা হয়নি। আসলে ভোট এমনই হওয়া উচিত।’

গতকাল সকাল আটটায় খুলনা সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরুর আগেই কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে ভোট গ্রহণ শুরুর পর অধিকাংশ কেন্দ্রে উপস্থিতি কমে আসে। দুপুরের পর মূল শহরের বাইরের এলাকায় কিছুটা ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে। তবে শহরের ভেতরে দিনভর ভোটারদের উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল।

ভোটকেন্দ্রের বাইরে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টরা ছিলেন। কেন্দ্রের ভেতরেও পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

এবার খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ ৩১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সিটি করপোরেশনের মধ্যে মোট ভোটার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬ জন এবং পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ২৮৯টি।

তালুকদার খালেকের নিজ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের নিজ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা কম ছিল। তাঁর বাসার পাশে পাইওনিয়ার বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুটি কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ১৯০। সেখানে ভোট দিয়েছেন ১ হাজার ১২৩ জন।

ভোট গ্রহণ শুরুর এক ঘণ্টা পর তালুকদার খালেকের কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল মাত্র ৯৪ জন। সোয়া ৯টার দিকে তালুকদার খালেক ভোট দিতে এলে তাঁর সঙ্গে বিপুল নেতা–কর্মী ছিলেন। তবে ভোট পড়ার হার তখন অনেক কম ছিল। দুপুর ১২টার দিকে ওই কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত ভোট পড়েছিল মাত্র ৬০৪ জন। অর্থাৎ প্রথম চার ঘণ্টায় ভোট পড়ে ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। দিন শেষে এই হার গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ২০ শতাংশে।

এদিকে নগরীর গল্লামারী এলাকায় লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নারী ভোটকেন্দ্রে ভোট শুরুর আধা ঘণ্টা পর ভোট পড়ার হার ছিল ১ শতাংশের কম। দুপুর ১২টায় এই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ১৮ শতাংশ। দিন শেষে দেখা যায়, এই কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ৪০ শতাংশ। কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মহিবুল্লাহ আল কাফী প্রথম আলোকে বলেন, দিনভর ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকলেও বেলা তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।

যে কারণে ভোটার উপস্থিতি কম

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন অংশগ্রহণ না করার পাশাপাশি দলের কর্মী সমর্থকদেরও ভোট প্রদানে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে খুলনা সিটি নির্বাচনে। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, সাধারণ মানুষও এই নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

মেয়র পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হচ্ছেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার এটিও একটি কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ। যেসব কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বেশি লক্ষ করা গেছে, সেখানে মূলত স্থানীয় কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের ভোট দিতেই ভোটাররা কেন্দ্রে গেছেন।

খুলনা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিলেন না। এ কারণে নির্বাচন নিয়ে মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না। ভোটে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আর বিএনপির নেতা–কর্মীদের ভোটদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সেটি দলের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণও করা হয়েছে।

বিএনপির প্রার্থী না থাকার প্রভাব নির্বাচনে পড়েছে, সেটা আওয়ামী লীগের নেতারাও বলেছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম ছিল, বিষয়টি এমন নয়। বিএনপি নির্বাচনে না আসার কারণে ২০ শতাংশ ভোট কম পড়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত করে বিএনপি কিছু ভোট ঠেকিয়েছে। তারা তাদের নেতা–কর্মীদের ভোট দিতে নিষেধ করেছে।

ইভিএম–বিভ্রাট

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা বিড়ম্বনায় পড়েছেন। ইভিএম–বিভ্রাটে কেউ কেউ ভোট দিতে পারেননি। এমন একজন হলেন উত্তর দেয়ানা এলাকার নাদিরা বেগম। একটি ভোটকেন্দ্রে হাতে মেহেদি থাকার কারণে ইভিএমে তাঁর আঙুলের ছাপ মেলেনি। এ কারণে তিনি ভোট না দিয়েই ফিরে গেছেন।

একই কেন্দ্রে আরেক নারী চারবার চেষ্টা করার পর আঙুলের ছাপ মিলেছে। পরে তিনি ভোট দিতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সুকৃতি মন্ডল। আরেকটি কেন্দ্রে একজন বয়স্ক নারী ভোট দেওয়ার সময় ইভিএমের ব্যালট প্যানেলে জোরে চাপ দেওয়ায় যন্ত্রটি বিকল হয়ে যায়। ২৫ মিনিট পর নতুন যন্ত্র বসানোর পর তিনি ভোট দিতে পেরেছেন।

‘স্মার্ট কারচুপির’ অভিযোগ

খুলনা সিটি নির্বাচনে স্মার্ট কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ফলাফল ঘোষণা চলাকালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুল আউয়াল গতকাল রাত আটটার দিকে খুলনা নগরের পাওয়ার হাউস মোড় এলাকায় দলের নগর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন।

খুলনার নির্বাচনে নানা অনিয়ম হয়েছে উল্লেখ করে আবদুল আউয়াল বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো আমাদের ভোটার হাতপাখায় চাপ দিলে নৌকা ভেসে উঠেছে। আমরা মনে করি, মেশিনটাকে ওইভাবে সাজানো হয়েছে। কতটা হাতপাখায় আসবে, কতটা নৌকায় যাবে, তা সাজানো ছিল।’

জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক এবং খুলনা জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল কাদির নির্বাচনের সার্বিক চিত্র নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে এমনিতেই ভোটাররা আগ্রহ হারান। আর মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী যাঁরা হন, তাঁদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও মানুষ ভোট দিতে আগ্রহ হারান। খুলনার নির্বাচনে এই দুটি বিষয় বিদ্যমান ছিল। এ কারণে ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল না। ভোটার উপস্থিতিও তাই কম ছিল।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মোহাম্মদ মোস্তফা, আহমদুল হাসান, শেখ আল–এহসান ও উত্তম মণ্ডল]