‘ভুঁইফোড়’ দুই দলের নিবন্ধন কি সরকারের পরামর্শে

নিবন্ধন পাওয়া বিএনএম ও বিএসপিকে অনেকে দেখছেন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে। এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে দল দুটি।

নির্বাচন কমিশন

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সক্রিয় অনেক দলকে বাদ দিয়ে ‘ভুঁইফোড়’ দুটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন সংস্থাটি আসলে সরকারের পরামর্শেই চলছে কি না, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে।

ইসির নিবন্ধন পেতে ৯৩টি দল আবেদন করেছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) নামের দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। ইসি গতকাল এ–সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

এই দুটি দলের তেমন কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। দল দুটিকে অনেকে দেখছেন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে। নির্বাচন কমিশন ও এর কর্মকর্তাদের কারও কারও মধ্যে এই দল দুটিকে নিবন্ধন দেওয়া নিয়ে অস্বস্তি আছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।

ইসি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। মাত্র দুটি দল সব শর্ত পূরণ করেছে। বাকিগুলো শর্ত পূরণ করেনি। সে কারণে তাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
মো. আলমগীর, নির্বাচন কমিশনার

গতকাল সোমবার আটটি জেলা এবং এসব জেলার উপজেলা পর্যায়ে দল দুটির বিষয়ে খোঁজ করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে অনেক জায়গায় এ দুটি দলের কার্যালয় থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব কার্যালয়ের বেশির ভাগই অস্থায়ী। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা এসব কার্যালয় ভাড়া করে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কার্যালয় ভাড়া করে দিয়েছেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। আর অনেক জায়গায় বিএনএমের কমিটি গঠন করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির লোকজন দিয়ে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগঘেঁষা একটি রাজনৈতিক জোটেরও চেয়ারম্যান।

তবে বিএনএমের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা। বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য। ২০২১ সালে গঠিত হয় দলটি। তখন এই দলের গঠনের পেছনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকারের কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ থাকতে পারে, এমন অভিযোগ করেছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। বিএনপি নেতাদের কাউকে কাউকে এই দল থেকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী করা হতে পারে, এমন আলোচনাও রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগঘেঁষা একটি রাজনৈতিক জোটেরও চেয়ারম্যান।

নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীনদের কৌশলের অংশ হিসেবে এই দল দুটিকে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে, এমন আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে জোরদার হচ্ছে। নিবন্ধন না পাওয়া ১০টি দল গতকাল একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, সরকারের নির্দেশনায় এবং বিভিন্ন এজেন্সির পরামর্শে ‘ভুঁইফোড়’ দুটি দল ছাড়া কাউকে নিবন্ধন দেয়নি ইসি। বিএনপির মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির লক্ষ্যে এই দলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।

বিএনএমের মূল নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা। বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য। ২০২১ সালে গঠিত হয় দলটি।

অভিযোগ অস্বীকার ইসির

অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসি। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কথায় চলে না। ইসি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তিনি উল্লেখ করেন, আইন অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কার্যালয়, কমিটি ও সদস্য আছে কি না, এসব প্রথমে তদন্ত করা হয়েছে।

আইনে দলের অ্যাকটিভিটি (কার্যক্রম) দেখার কোনো সুযোগ নেই। আপনার ধারণা অনুযায়ী কোনো নিবন্ধন দেওয়া হবে না। নিবন্ধন দেওয়া হবে আইনের ভিত্তিতে।
মো. আলমগীর

সেখানে পাওয়া তথ্য সঠিক কি না, তা উচ্চপর্যায়ের আরেকটি কমিটি তদন্ত করেছে। দুটি কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী মাত্র দুটি দল সব শর্ত পূরণ করেছে। বাকিগুলো শর্ত পূরণ করেনি। সে কারণে তাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, এর সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কোনো প্রতিবেদনও তাঁরা চাননি।

যে দল দুটিকে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে, তাদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মো. আলমগীর বলেন, ‘আইনে দলের অ্যাকটিভিটি (কার্যক্রম) দেখার কোনো সুযোগ নেই। আপনার ধারণা অনুযায়ী কোনো নিবন্ধন দেওয়া হবে না। নিবন্ধন দেওয়া হবে আইনের ভিত্তিতে।’

আরও পড়ুন

সরেজমিন যা দেখা গেল

রাজশাহীতে বিএনএমের কার্যালয় ও কমিটি পাওয়া গেছে। দলের নেতারা বেশির ভাগ এসেছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি থেকে। দলটির রাজশাহী জেলা কমিটির সদস্য সচিব মো. শরিফুল ইসলাম আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই তাঁরা নতুন দলে যোগ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর বাগমারা ও চারঘাটে বিএনএমের উপজেলা কার্যালয় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পাশে। আর তানোর উপজেলা কার্যালয়টি মূলত একটি কফি হাউস। সেটির একাংশ ভাড়া নিয়ে দুই মাস ধরে বিএনএমের কার্যালয় খোলা হয়েছে। দলটির তানোর উপজেলা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৩১ সদস্যের কমিটির সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা ছিলেন। উপজেলা সভাপতি মমিনুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, তাঁদের কমিটির সবাই আওয়ামী লীগে ছিলেন। আর চারঘাটে বিএনএমের কমিটি করেছেন জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতারা।

বাগমারা উপজেলা কার্যালয়টি খোলা হয়েছে উপজেলার তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পাশে। স্থানীয় লোকজন জানান, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পাশের ছোট্ট ঘরটিতে আগে যুবলীগের নেতারা বসতেন। তার ওপরেই বিএনএমের ব্যানার লাগানো হয়েছে।

এটি আশ্চর্যের যে, যেসব দলের নাম সেভাবে শোনা যায়নি, কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি, তারা কীভাবে নিবন্ধনের কঠিন সব শর্ত পূরণ করেছে? আবার যেসব দলের কর্মকাণ্ড অনেক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দল নিবন্ধন পায়নি। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন

কুষ্টিয়ায় বিএনএমের ১৯ সদস্যের কমিটির বেশির ভাগ সোনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দলটির স্থানীয় একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস আগে একটি সংস্থার তিনজন লোক এসে তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে এই কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। দলের কার্যালয়সহ সব কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে আর্থিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তাঁরা। অগ্রিম ৯ হাজার টাকা দিয়ে দেড় মাসের জন্য অফিসভাড়া পরিশোধ করেন। ওই সংস্থার লোকজন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। তবে কুষ্টিয়া বিএনএমের আহ্বায়ক মোস্তফা কামাল মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, কুষ্টিয়া কার্যালয়ের ভাড়া তিনি পরিশোধ করেন।

ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকার মহিম স্কুলের মোড় এলাকায় মৌ সুপার মার্কেটে একটি মোটরসাইকেল গ্যারজের পাশে বিএসপির কার্যালয়ের জিজিটাল সাইনবোর্ড দেখা গেছে। ওই মার্কেটের মালিক ফরিদপুর শ্রমিক লীগের একাংশের সভাপতি আক্কাস হোসেন। তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়েই নতুন দল বিএসপির কার্যালয় হিসেবে সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে।

নরসিংদী রায়পুরার আদিয়াবাদ ইউনিয়নের রাধাগঞ্জ বাজারের উত্তরপাড়া এলাকায় বিএসপির কার্যালয়। সেখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া অর্ধশতাধিক শিশুকে পড়াতে দেখা গেছে চার নারী শিক্ষককে। ওই শিক্ষকেরা জানান, এটি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাম মনমেলা। এখানে এলাকার শিশুদের স্কুল ছুটির পর বিনা বেতনে পড়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি যে পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিএসপির সভাপতিও ওই পরিবারেরই সদস্য।

আরও পড়ুন

সিলেট নগরের কাজীটুলা এলাকার মূল সড়কের পাশেই একটি দোতলা ছোট ভবনে একটি ডোকোরেটর্সের দোকানের পাশে বিএনএমের জেলা কার্যালয়। তবে এখানে কেউ আসেন না। ফলে অনেকটা ‘পরিত্যক্ত’ অবস্থায়ই কক্ষটি রয়েছে। ভবনটির মালিক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক ব্যক্তি।

তাঁর মামা মো. এনাম উদ্দিন ভবনটি দেখভাল করেন। এনামের পক্ষে কক্ষটি বিএনএমের কাছে ভাড়া দিয়েছেন নিচতলার ভাড়াটে ও পোলট্রি ব্যবসায়ী আমীর হোসাইন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর একটি সংগঠনের কার্যালয় স্থাপনের কথা বলে দুজন ঠিকাদার ও শ্রমিক লীগ নেতা কক্ষটি ভাড়া নেন। তবে ভাড়া নিলেও কক্ষটিতে সংগঠনের কোনো কার্যক্রম তাঁর চোখে পড়েনি।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকার মুন্সী পুকুরপাড়–সংলগ্ন কাপাসগোলা মকবুল সওদাগর লেনে একটি বিশাল ভবনের ভেতরে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয় অবস্থিত। এটি রাজনৈতিক দলের জেলা কার্যালয় হলেও স্থানীয় লোকজন তা জানেন না। সবাই চেনেন ‘মাইজভান্ডারী মঞ্জিল’ হিসেবে। দলের চেয়ারম্যান শাহ্জাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী ওই ভবনেই থাকেন।

আরও পড়ুন

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি আশ্চর্যের যে, যেসব দলের নাম সেভাবে শোনা যায়নি, কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি, তারা কীভাবে নিবন্ধনের কঠিন সব শর্ত পূরণ করেছে? আবার যেসব দলের কর্মকাণ্ড অনেক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দল নিবন্ধন পায়নি। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন আছে।’

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার মনে করেন, ইসি বিষয়গুলো পরিষ্কার না করলে সন্দেহ বাড়বে। সে জন্য দলগুলো কোন কোন জেলা ও উপজেলায় কমিটি ও কার্যালয় থাকার তথ্য দিয়েছে, তা ইসির প্রকাশ করা উচিত।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট স্থানের প্রতিনিধিরা]