সায়েদুল হক সুমন বললেন, ‘প্রতিশোধের আগুনে খালি আমরা পুড়তেছি না...’

সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকার আদালত থেকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আজ সোমবার সকালে, ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে থেকে তোলা ছবিছবি : আসাদুজ্জামান

তখন বেলা ১১টা ১৫ মিনিট। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার প্রধান ফটকের সামনে মানুষের জটলা। এ সময় নীল রঙের একটি প্রিজন ভ্যান হুইসেল বাজিয়ে হাজতখানার ভেতর থেকে বের হয়। প্রিজন ভ্যানটি তখন দ্রুত গতিতে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকে।

গাড়িটি যখন সিএমএম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে, তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে দেখা যায়। তিনি প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর এক স্বজনের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে থাকেন। তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুই হাত প্রসারিত করে গাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।

সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকার আদালত থেকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আজ সোমবার সকালে ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে
ছবি : আসাদুজ্জামান

হাসানুল হক ইনু তখন আদালতে চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর আইনজীবী ও স্বজনদের প্রিজন ভ্যানের ছোট্ট লোহার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকেন। হাসানুল হক ইনুর পাশে প্রিজন ভ্যানে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনিও আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্বজনদের প্রিজন ভ্যানের লোহার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকেন।

আরও পড়ুন
সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে চিৎকার কথা বলতে থাকেন। আজ সোমবার সকালে ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে থেকে তোলা ছবি
ছবি : আসাদুজ্জামান

প্রিজন ভ্যানটি যখন সিমএমএম আদালতে প্রবেশের প্রধান ফটক পেরিয়ে পুরোনো ঢাকার রায়সাহেব বাজারে সড়কে আসে, তখন দেখা যায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক পিজন ভ্যানের ভেতরে চুপ করে এক কোনায় বসে আছেন। তাঁর পাশে বসে আছেন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। আনিসুল হক ও আতিকুল ইসলাম দুজনে কেউ কোনো কথা বলছেন না।

প্রিজন ভ্যানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপ। তিনি পরেছিলেন সাদা রঙের পায়জামা ও পাঞ্জাবি। আবদুস সোবহান গোলাপের পাশে বিমর্ষ অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সায়েদুল হক সুমন। তিনি তখন চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘প্রতিশোধের আগুনে খালি আমরা পুড়তেছি না, পুরো দেশটা পুড়াই ফেলছেন...।’

সায়েদুল হক সুমন যখন চিৎকার করে এসব কথা বলছিলেন, তখন উল্টো পাশের প্রিজন ভ্যানের লোহার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান। প্রিজন ভ্যানটি তখন দ্রুত গতিতে রায়সাহেব বাজার মোড় হয়ে নয়াবাজারের দিকে এগোতে থাকে।

এর আগে সকাল আটটার দিকে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করেই সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনকে ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানায় এনে রাখা হয়।

আরও পড়ুন
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকার আদালত থেকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আজ সোমবার সকালে ঢাকার সিএমএম আদালতের সামনে থেকে তোলা ছবি
ছবি : আসাদুজ্জামান

সকাল ১০টার দিকে তাঁদের হাজতখানার ভেতর থেকে বের করে আদালতকক্ষে নেওয়া হয়। তখন আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, সৈয়দ সায়েদুল হকদের প্রত্যেকের দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো ছিল। মাথায় ছিল পুলিশের হেলমেট। বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।

সায়েদুল হক সুমনকে যখন আদালতকক্ষে নেওয়া হচ্ছিল তখন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতে থাকেন, ‘প্রতিশোধের আগুনে কেবল আমরা পুড়তেছি না, পুরো দেশ পোড়ায় দিয়েছেন।’

আজ সোমবার পৃথক পৃথক হত্যা মামলায় আনিসুল, ইনু, মেননদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম শ্রেণির কারাবন্দীদের রাখার জন্য বিশেষ কারাগার চালু হয়েছে। কাশিমপুরসহ অন্য কারাগারে থাকা আসামিদের কেরানীগঞ্জ কারাগারে রাখা হয়েছে।

দুর্নীতির মামলায় মহানগর আদালতের কাঠগড়ায় সালমান

বেলা ১১টার পর আনিসুল হকদের প্রিজন ভ্যানটি ঢাকার সিএমএম আদালতের হাজতখানা থেকে বের করার পর আরেকটি প্রিজন ভ্যান হাজতখানা থেকে বের হয়। সেই প্রিজন ভ্যানে ছিলেন সালমান এফ রহমান। পরে তাঁকে আনা হয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে চুপচাপ বসেছিলেন সালমান। কাঠগড়ায় তোলার পর তার দুই হাত পেছনে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হাতকড়া খুলে দেয় পুলিশ। মাথার হেলমেটটিও খুলে ফেলা হয়। পরে কাঠগড়ায় রাখা একটি চেয়ারে তিনি বসেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকে আদালতের হাজতখানায় নেওয়ার আগে প্রিজন ভ্যানে। আজ সোমবার সকালে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে
ছবি : আসাদুজ্জামান

তখন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে অন্য মামলার শুনানি গ্রহণ করছিলেন বিচারক ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে যখন অন্য মামলার শুননি হচ্ছিল, তখন মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে ছিলেন সালমান। বেলা একটার পর ভুল চিকিৎসা–সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানি করছিলেন একজন আইনজীবী। পরে সালমান এফ রহমানের মামলার শুনানি শুরু হয়। এ সময় সালমান এফ রহমান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন।

দুদকের পক্ষ থেকে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আদালতকে বলেন, ‘সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা রয়েছে। সেই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।’

পিপি মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এ মামলা হয়েছে। বন্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন
প্রিজন ভ্যানের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। আজ সোমবার সকালে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনে
ছবি : আসাদুজ্জামান

এ সময় মাহমুদ হোসেন আদালতকে আরও বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে যাঁরা অর্থ পাচার করে, তাঁরা জাতির শত্রু। এ সময় আদালত বলেন, ‘দুদকের দায়ের করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। এই মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হোক।’

আদালতের এই আদেশের পর কাঠগড়ায় থাকা সালমান এফ রহমানের দুই হাত পেছনে নিয়ে আবার হাতকড়া পরিয়ে দেয় পুলিশ। মাথায় পরানো হয় হেলমেট। পরে তাঁকে এজলাসকক্ষ থেকে বের করে নেওয়া হয় প্রিয়জন ভ্যানের কাছে।

সালমান এফ রহমানকে প্রিজন ভ্যানে তোলার পর পুলিশ তাঁর দুই হাতে পরানো হাতকড়া খুলে ফেলে। মাথা থেকেও খুলে ফেলা হয় হেলমেট।

তখন সালমান এফ রহমানকে দেখা যায় প্রিজন ভ্যানের ভেতরে থাকা লোহার বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন মাথা নিচু করে। পরে প্রিজন ভ্যান কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তখনো সালমান এফ রহমান চুপচাপ বসে ছিলেন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে।