ভোটার নিবন্ধনের কাজ হচ্ছে ওয়ার্ড আ.লীগ কার্যালয়ে

প্রতীকী ছবি

ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বিধান থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ভোটার নিবন্ধনের কাজ চলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কার্যালয়ে। স্থানীয় মসজিদের মাইকে মাইকিং করে ভোটার হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ওই কার্যালয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে নির্বাচন–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দলীয় কার্যালয়ে ভোটার নিবন্ধনের কাজটি বেআইনি এবং এর মাধ্যমে ভোটার তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভোটার হতে মানুষ আসছেন ওই কার্যালয়ে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে দায়িত্ব পাওয়া একজন তথ্য সংগ্রহকারী ওই কার্যালয়ে বসে ভোটার নিবন্ধনের ফরম পূরণের কাজ করছেন।

ভোটার তালিকা আইনের বিধিমালা অনুযায়ী, তথ্য সংগ্রহকারীকে ফরম নিয়ে নির্ধারিত ভোটার এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। ভোটার তালিকা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য বিধিমালায় বলা আছে, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের কোনোভাবেই তথ্য সংগ্রহকারী বা সুপারভাইজার পদে বিবেচনা করা যাবে না। অথচ ভোটার নিবন্ধনের কাজই করা হচ্ছে একটি দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

তথ্য সংগ্রহের জন্য শিক্ষকেরা বাসায় বাসায় যাবেন। বাজারে অনেক মানুষ আসে, এ কারণে হয়তো কোনো তথ্য সংগ্রহকারী কার্যালয়ে বসেছেন। এলাকার কেউ হয়তো নিজ উদ্যোগে মাইকিং করে থাকতে পারে।
মো. শফিউল্লাহ, আওয়ামী লীগের সভাপতি

তেজগাঁও এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (দক্ষিণ–পূর্ব তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ভোটার এলাকা ১২২৮) দুটি দল তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। এর মধ্যে একটি দলের সদস্যরা তেজগাঁওয়ের শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। অন্য দলে আছেন আইডিয়াল প্রিক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলের শিক্ষকেরা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুটি দলের সদস্যরাই স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন। ভোটার হতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য দিনের বিভিন্ন সময়ে কার্যালয়ের পাশের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ওই কার্যালয়ে বসে তথ্য সংগ্রহের কাজ করা হয়।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে একটি বড় টেবিলের এক পাশে একজন তথ্য সংগ্রহকারী এক নারী ভোটার নিবন্ধনের ফরম নিয়ে বসে আছেন। তিনি এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলেন। এই ব্যক্তির ছেলে কীভাবে ভোটার হবে, তা তথ্যসংগ্রহকারীর কাছে জানতে চাচ্ছিলেন। বিস্তারিত শোনার পর ওই ব্যক্তি ফোনে ছেলেকে জন্মনিবন্ধন সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেন। কিছুক্ষণ পরই ছেলে কাগজপত্র নিয়ে সেখানে হাজির হন।

পরে বাবা ও ছেলের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। ভোটার হতে ইচ্ছুক ওই তরুণের নাম মো. মুহিনুল হাসান রিজবী। তাঁর বাবা মো. রেহান উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় স্কুলে গিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভোটার করা হচ্ছে। এ ছাড়া মাইকিংও করা হয়েছে।

বাড়ি বাড়ি না গিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসে ভোটার নিবন্ধনের কাজ করার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহকারী কবিতা রানী ভদ্র প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখানে (কার্যালয়ে) বসেন না। বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। তবে বাড়িতে গিয়ে অনেককে পাচ্ছেন না। তাঁর একজন সহকর্মী তাঁকে কিছু কাগজপত্র দেবেন। এ কারণে তিনি সেখানে এসেছেন।

তবে ওই কার্যালয়ে এই প্রতিবেদক অবস্থান করার সময়ই দেখা যায়, রিজবীকে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করতে ফরম পূরণ করেন কবিতা রানী। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন মোছাম্মৎ লাভলী নাসের এক গৃহিণী। তিনি এসেছেন মেয়েকে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত করাতে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, এলাকার মসজিদে মাইকিং করে বলেছে, এখানে ভোটার করা হচ্ছে। তাঁর বাড়িওয়ালার ছেলেও এখানে এসে ভোটার হয়েছেন। তাঁর বাড়িতে কেউ তথ্য সংগ্রহ করার জন্য যায়নি। তিনি এর আগেও এই কার্যালয়ে এসেছিলেন। তখন তাঁকে জানানো হয়েছিল, কিছু কাগজপত্র প্রয়োজন। সে কারণে তিনি কাগজপত্র নিয়ে এসেছেন।

২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর ইউনিটের ভোটার তালিকার কাজ এখানে করা হচ্ছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে তাঁদের বলা হয়েছে। এ কারণে তাঁরা দলীয় কার্যালয় ব্যবহার করতে দিয়েছেন। ভোটার হওয়ার জন্য এলাকার মসজিদে তাঁদের উদ্যোগেই মাইকিং করা হয়েছে। দলীয় কার্যালয়ে ভোটার নিবন্ধনের কাজ করা উচিত হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি নির্দলীয়ভাবেই হচ্ছে। সবাই আসছেন।

২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিউল্লাহ অবশ্য দাবি করেন, দলের কার্যালয়ে ভোটার নিবন্ধনের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য সংগ্রহের জন্য শিক্ষকেরা বাসায় বাসায় যাবেন। বাজারে অনেক মানুষ আসে, এ কারণে হয়তো কোনো তথ্য সংগ্রহকারী কার্যালয়ে বসেছেন। এলাকার কেউ হয়তো নিজ উদ্যোগে মাইকিং করে থাকতে পারে।

প্রতিবছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার বিধান আছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর হালনাগাদ কার্যক্রমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেনি ইসি। গত ২০ মে থেকে সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হয়। মোট চারটি ধাপে এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। গত ৩০ জুলাই থেকে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি চলবে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত।

তেজগাঁও এলাকার নির্বাচন কর্মকর্তা খায়রুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই কাজ হওয়ার কথা নয়। সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কথা। তাঁরা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সবাইকে নির্দেশনা দেবেন।

নির্বাচন–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কথা থাকলেও সে কাজটি এখন আর যথাযথভাবে হয় না। এ কারণে দিন দিন নারী ভোটার কমছে। সর্বশেষ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি।

কিন্তু নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার বেশি ছিল। কিন্তু এখন পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা কম। এখন মোট ভোটারের প্রায় ৫১ শতাংশ পুরুষ আর ৪৯ শতাংশ নারী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করার নিয়ম থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজটি হয়নি। নারী ভোটার কমে যাওয়ার এটি একটি কারণ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৭ সালে করা ছবিসহ ভোটার তালিকা ছিল দেশের গর্ব। কিন্তু নূরুল হুদা কমিশনের সময় থেকে এটি ক্রমে নষ্ট হচ্ছে। দিন দিন নারী ভোটারের সংখ্যা কমছে, এতে বোঝা যায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজটি হচ্ছে না।

যা ভোটার তালিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কার্যালয়ে বসে ভোটার তালিকা করার কাজ শুধু এই কার্যক্রমের সঠিকতাই নষ্ট করছে না, ভোটার তালিকাকে দলীয়করণের সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কারণ হয়ে উঠতে পারে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সঠিক ভোটার তালিকা অপরিহার্য।