ক্ষমতায় গেলে যুক্তরাজ্যের আদলে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ গড়ে তুলবে বিএনপি

বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আজ মঙ্গলবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাতীয় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেনছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচসির আদলে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপিকে যদি জনগণ পছন্দ করে আগামী নির্বাচনে সরকারে পাঠায়, তাহলে আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই যে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে আমাদের উপস্থাপিত সবকিছু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাব।’

আজ মঙ্গলবার সকালে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই রূপরেখা তুলে ধরেন।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ‘ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজ’–এর আলোকে বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখায় ২৬তম ধারায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ধারা অনুযায়ী বিএনপি সবার জন্য স্বাস্থ্য—এই নীতির ভিত্তিতে কল্যাণকামী উন্নত রাষ্ট্রে বিদ্যমান ব্যবস্থার আলোকে সবার জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ বলেন, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) বা এ জাতীয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইউনিভার্সেল হেলথ কাভারেজের আলোকে সবার জন্য সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

স্বাস্থ্য খাতসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিএনপি আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে দারিদ্র্য বিমোচন না হওয়া পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত হতদরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী আরও সম্প্রসারিত করব। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশের কম হবে না। প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ, পল্লী স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা করা হবে। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’

খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আলোচনায় প্রায়ই মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের অধীনে রেজিস্টার্ড মেডিকেল চিকিৎসকদের বিবেচনায় রেখে সব পরিকল্পনা-নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ফলে দেশে বিদ্যমান প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী প্রথাগত মেডিসিন…ইউনানি, আয়ুর্বেদী, হোমিওপ্যাথিক, কবিরাজি চিকিৎসা ব্যবস্থার অস্তিত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার অধিকতর উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও বৈজ্ঞানিক করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও বিবিধ সহায়তা প্রদান সমান গুরুত্বপূর্ণ।’

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে অনিয়ম, আর্থিক দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন, দলীয়করণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে কুক্ষিগত করার ফলে ‘চিকিৎসক ও রোগী সম্পর্কের অবনতি, বিদেশমুখী চিকিৎসার বিস্তার’ ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন এই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক উন্নয়নে তিন ধাপে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবে স্বল্পমেয়াদি (এক থেকে তিন বছর) পরিকল্পনা রয়েছে। এতে আমরা গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগের ওপর ‍গুরুত্ব দিয়েছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবার গুণগত মান উন্নয়ন এবং কার্যকরী প্রাথমিক রেফারেন্স সেন্টার হিসেবে রূপান্তর, প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত সেবা নিশ্চিত করা, পরিকল্পিত পরিবার ও জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনার কথা বলেছি।’

খন্দকার মোশাররফ আরও বলেন, জিপি-জেনারেল ফিজিশিয়ানের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে একজন সরকারি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের অধীনে রাষ্ট্রীয় খরচে সর্বোত্তম স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্যমান জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত স্তরের স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ ও সঠিক রেফারেন্স সিস্টেম বাস্তবায়ন করা হবে, ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন, জরুরি চিকিৎসাসেবা, দুর্ঘটনা–পরবর্তী সেবা, দ্রুত স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসেবায় ন্যায়বিচার, রোগী ও সেবা প্রদানকারীর জন্য সমতাভিত্তিক আইন প্রণয়ন, সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক উন্নয়নের কার্যকর ব্যবস্থা করা।

এ ছাড়া ‘মধ্যমেয়াদি’ (এক থেকে পাঁচ বছর) এবং ‘দীর্ঘমেয়াদি’ (১০ বছর পর্যন্ত) পরিকল্পনার মাধ্যমে গোটা স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন খন্দকার মোশাররফ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আমাদের প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করছি। তবে আমরা আশা করি না যে তারা এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা রাখে বা সেই সময় পর্যন্ত তারা থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এসব প্রস্তাব গ্রহণ করে ভবিষ্যতে জনগণের যে সরকার আসবে, তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। আর বিএনপিকে যদি জনগণ পছন্দ করে আগামী নির্বাচনে সরকারে পাঠায়, তাহলে আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই যে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে আমাদের উপস্থাপিত সবকিছু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালাব।’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ওই আন্দোলনে আহতদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থার দাবিও জানান খন্দকার মোশাররফ।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হালিম (ডোনার) এক প্রশ্নের জবাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের স্বাস্থ্য খাত নষ্ট করে পার্শ্ববর্তী দেশে আমাদের লোকদের চিকিৎসার জন্য পাঠানো। তার জন্য প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার আমাদের এখান থেকে চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশে। এটাই বাস্তবতা।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের সমন্বয়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর উপস্থিত ছিলেন।