পুরোনো ‘গুমর’ নতুন করে ফাঁস করল জাতীয় পার্টি

জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদকে দেখতে ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সিএমএইচে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী
ফাইল ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘বিনা ভোটের’ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোটের’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচনা করে আসছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। তবে দুটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ‘বড় পুরস্কার’ পেয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের কারণে পরপর দুই মেয়াদে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারলেও জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে অনেকে তামাশা করেন। সেই জাতীয় পার্টির নেতাদের বক্তব্যে ২০১৪ সালের ভোট নিয়ে পুরোনো বিতর্ক নতুন করে আলোচনায় এসেছে। হঠাৎ তর্কবিতর্কে জড়িয়ে দলটির নেতারা ‘পুরোনো গুমর’ ফাঁস করে দিয়েছেন।

জাতীয় সংসদে বিতর্কটি উঠেছিল গত সোমবার। সেদিন লালমনিরহাট-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জামানত হারিয়েছিলেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এরশাদ তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমরা একটি আসন (রংপুর সদর) রেখে বাকিগুলো প্রত্যাহার করি।
কাজী ফিরোজ রশীদ, জাপা দলীয় সংসদ সদস্য
রাজধানীর বারিধারার বাসায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এইচ এম এরশাদের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের সৌজন্য সাক্ষাৎ
ছবি: জিয়া ইসলাম

মোতাহারের এ বক্তব্য জাতীয় পার্টির নেতাদের গায়ে লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে সংসদেই প্রতিবাদ জানান জাতীয় পার্টির কয়েক বিক্ষুব্ধ সংসদ সদস্য। এ নিয়ে দুই পক্ষে হট্টগোল হয়। ওই দিন জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে বলেছেন, ২০১৪ সালে এরশাদ নির্বাচনই করেননি।

এরশাদ যদি নির্বাচনই না করে থাকেন, তাহলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয় কী করে? এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। যদিও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ফলাফল বলছে, ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোতাহার হোসেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮১৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

আরও পড়ুন

তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পেয়েছিলেন ৫ হাজার ৩৮১ ভোট। ইসির আইন অনুযায়ী, বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের এক-অষ্টমাংশের কম পেলে, অর্থাৎ যেসব প্রার্থী আট ভাগের এক ভাগের কম ভোট পাবেন, তাঁরা জামানত হারাবেন। জামানাত হারানোর অর্থ হচ্ছে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জামানত হিসেবে যে টাকা জমা দিয়েছিলেন, সেটি আর ফেরত পাবেন না।

ফলাফলের হিসাবে এরশাদ যে ভোট পেয়েছিলেন, তাতে তিনি জামানত হারিয়েছিলেন। অর্থাৎ মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এরশাদ জামানত হিসেবে যে টাকা জমা দিয়েছিলেন, তা বাজেয়াপ্ত হয়। নির্বাচন কমিশনের ফলাফল মেনে নিলে এ ক্ষেত্রে মোতাহার হোসেনের বক্তব্যই সঠিক। তাহলে বিতর্কটা কোথায়? কেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বললেন, ২০১৪ সালে এরশাদ নির্বাচনই করেননি।

জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি অংশ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যায়। তখন কারা সংসদে যাবে, তার একটি তালিকা হয়। ওই তালিকা ধরেই কাউকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, কাউকে সমঝোতার নির্বাচনে বিজয়ী করা হয়।

২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছিল। এরশাদ নিজে ঢাকা-১৭, রংপুর-৩ ও লালমনিরহাট-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু নির্বাচনের আগমুহূর্তে এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচন বর্জন করেছে, জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ নেবে না। এরপর তিনি দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিলেন। তাঁর ঘোষণায় দলের অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। তাঁরা নির্বাচনে থেকে যান। আর এ কাজে সরকারের হয়ে রওশনকে সহায়তা করেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু (প্রয়াত)। এ নিয়ে জাতীয় পার্টি দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

নির্বাচন ঘিরে যখন এমন নাটকীয়তা চলছিল, তখন তথ্য সংগ্রহের জন্য বারিধারায় এরশাদের বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কে সাংবাদিকদের ভিড় লেগে থাকত দিনভর। এরশাদ কখন কী বলেন, কী করে বসেন, সেদিকেই ছিল সবার নজর। নির্বাচন ঘিরে যখন রাজনীতিতে ভীষণ উত্তেজনা, তখন ঝটিকা সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। তিনি এরশাদের সঙ্গে তাঁর বাসায় একান্ত সাক্ষাৎ করেন। সুজাতা সিং নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরপরই এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সুজাতা সিং তাঁকে নির্বাচনে যেতে বলেছেন।

সুজাতা সিংয়ের এই দূতিয়ালি এরশাদের মুখে প্রকাশিত পাওয়ার পর তিনি যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় অটল রয়েছেন, তা আরও শক্তভাবে প্রকাশ পায়। তখন সরকারি মহল থেকে এরশাদকে নানাভাবে বোঝানোর পাশাপাশি চাপ প্রয়োগ করেও নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা চলে। একপর্যায়ে চাপে পড়ে এরশাদ নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দেন। এমনই একটি পর্যায়ে হঠাৎ এরশাদকে ঢাকা সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।

তখন জাতীয় পার্টির নেতাদের একাংশ অভিযোগ করেন, নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় সরকার চিকিৎসার নামে এরশাদকে হাসপাতালে আটকে রেখেছে। তিনি হাসপাতালে ২৩ দিন ধরে ‘আটক’ ছিলেন। হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই নির্বাচন হয়।

পরে ভোটের যে ফলাফল নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করল, তাতে দেখা গেল, ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পরও এরশাদ রংপুর-৩ (সদর) আসনে জিতেছেন। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থী মো. সাব্বির হোসেনকে ২৯ হাজার ৮৬৭ ভোটে হারিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের ফলাফলে এরশাদের প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয় ৫৫ হাজার ৪৫৩ আর মো. সাব্বির হোসেনের (মশাল) ভোট ২৫ হাজার ৫৮৬।

আরও পড়ুন

কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে এরশাদ তিনটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমরা একটি আসন (রংপুর সদর) রেখে বাকিগুলো প্রত্যাহার করি। কারণ, আমরা মনে করেছি, ওনার সংসদে থাকা উচিত। কিন্তু উনি নির্বাচন করেননি।’

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি অংশ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যায়। তখন কারা সংসদে যাবে, তার একটি তালিকা হয়। ওই তালিকা ধরেই কাউকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, কাউকে সমঝোতার নির্বাচনে বিজয়ী করা হয়।

সরকারের এই কৌশলের কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর না হওয়ায় এরশাদ রংপুর-৩ আসনের নির্বাচনে থেকে যান এবং জিতেও যান। আবার একই কৌশলের ফেরে তিনি ঢাকা-১৭ ও লালমনিরহাট-১ আসনে পরাজিত হন। এর মধ্যে ঢাকা–১৭ আসনে, অর্থাৎ গুলশান, বনানী ও ঢাকা সেনানিবাস এলাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সংসদ সদস্য হয়েছেন বিএনএফ নামের একটি দলের প্রধান এস এম আবুল কালাম আজাদ। আর লালমনিরহাটের সংসদ সদস্য হন মোতাহার হোসেন, যিনি পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হন।

২০১৪ সালে এরশাদকে হারিয়েছেন বলে মোতাহার হোসেন গত মঙ্গলবার সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটার জবাব দিতে গিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, ‘সেই দিন বেগম রওশন এরশাদ এবং আমরা কয়েকজন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বেইমানি ও বিদ্রোহ করে বেগম এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করেছিলাম। আমরা শুধু লিগ্যাসির জন্য, এ সংসদে এরশাদ সাহেবের মতো লোক আছে, এটা প্রমাণ রাখার জন্য সেদিন আমরা কষ্ট করে তাঁকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করেছি। লালমনিরহাটে তিনি নির্বাচন করেন নাই।’

মোতাহার হোসেন ৯ বছর পর হঠাৎ এমন বক্তব্য দিতে গেলেন কেন? এ বিষয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ পরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য মোতাহার হোসেন সংসদে অযাচিতভাবে এরশাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা বলেছেন। দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি এরশাদের মতো ব্যক্তিকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন, যাতে আগামী দিনেও মনোনয়ন পান।’

২০১৪ সালের নির্বাচনকে বহুলভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত নির্বাচন মনে করা হয়। কারণ, একতরফা এ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১২৭ জন, জাতীয় পার্টির ২০ জন সংসদ সদস্য রয়েছেন। বাকি ১৪৭ আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতার নির্বাচন হয়। সব মিলে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসন এবং জাতীয় পার্টি ৩৪ আসন পান। নির্বাচনের পর একই সঙ্গে সরকারে থেকে ও বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করার বিরল উদহারণও সৃষ্টি করেছিল জাতীয় পার্টি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের ৯ বছর পর সেই নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির ‘সত্য’ প্রকাশের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো জানা কথা যে এরশাদ নির্বাচন করতে চাননি। তাঁকে সিকিউরিটি ফোর্স জোর করে সিএমএইচে নিয়ে গেল। প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রসচিব এসেও চাপ দিয়েছেন। তখন জাতীয় পার্টির একটি অংশ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে গেছে। সেটাই এখন জাতীয় পার্টির নেতাদের মুখ থেকে বের হলো, অনেকটা গুমর ফাঁস করার মতো ঘটনা।’