অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে যতটা মনোযোগ দিচ্ছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ততটা দিচ্ছে না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন জমা হওয়ার দেড় মাস পার হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কিছুই করেনি। অবিবেচনাপ্রসূতভাবে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত ‘শ্বেতপত্র ও অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে (সম্মেলন) বক্তারা এ কথা বলেন। সম্মেলন আয়োজন করে শ্বেতপত্র কমিটি-২০২৪। এতে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন কমিটির প্রধান এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তিনটি অধিবেশন ছিল। প্রথম অধিবেশনে অর্থনীতিবিদ, গবেষক, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সরকারি সংস্থার প্রধান ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এতে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
সম্মেলনের এ অধিবেশনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের মনোযোগ কম থাকা ও অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাট বাড়ানোর কথাটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনেকের মতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অর্থনৈতিক ইশতেহার নেই উল্লেখ্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের অধীনই পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংশোধিত বাজেট পেশ না করায় আগের বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সূচকই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ফলে যারা কর দেয় না, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানা গেল না, যা চিন্তিত করেছে। আগামী গরমে জ্বালানি পরিস্থিতি যে আরও জটিল হবে, সে আশঙ্কাও করছি।’ তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হার ধীর হয়ে পড়ছে, আবার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এদিকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে গেছে। সুষম, অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে যে ধরনের সংস্কার দরকার, তার রূপরেখা দেখা গেল না।
ভ্যাট বাড়ানোর সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কোনো দেশে সরকার যদি কার্যকরভাবে রাজস্ব আদায় করতে চায়, তাহলে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে, কিন্তু সে পরিকল্পনা দেখছি না। পরোক্ষ করের দিকে ঝোঁকার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’
সামস্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষার প্রতি নজর বাড়াতে আহ্বান জানান দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, এগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে যাঁরা সংস্কারকে গতিশীল করতে চান, তাঁরা ধৈর্যহারা হয়ে যাবেন।
টিসিবির পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করা সম্ভব বলে মনে করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। সে ক্ষেত্রে পণ্যগুলোর বিদ্যমান মূল্য সমন্বয় করতে হবে। মূল্য সমন্বয়ের মানে হচ্ছে মূল্য কিছুটা বাড়ানো।
এখন মূল্য সমন্বয় করা হলে ব্যাপক সমালোচনা হবে বলেও আশঙ্কা করেন শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘এটা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হতে পারে। আমরা রাজনীতিবিদ না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কি দীর্ঘ মেয়াদে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় ভোজ্যতেল কিনে ১০০ টাকায় বিক্রি করব? নাকি মূল্য সমন্বয় করে ১০০ টাকার বদলে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় নিয়ে এক কোটির জায়গায় দেড় কোটি বা দুই কোটি মানুষ পর্যন্ত প্রসারিত করব? এই চিন্তাগুলো আমাদের সাহসের সঙ্গে করতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, পণ্যমূল্যে আগুন বহির্বিশ্বে নিভে গেলেও বাংলাদেশে নেভেনি। না নেভার কারণও আছে। ফায়ার ব্রিগেড দেরিতে এসেছে। এসে আবার পানি ঢালার বদলে তেল ঢেলেছে। পরে দেখা গেল পাইপেও সমস্যা আছে।
দেশের অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘৩৪ বছর ধরে দেশে ব্যবসা করি। এমন টানাপোড়েন পুরো ব্যবসায়িক সময়ে দেখিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে বিনিয়োগ করার জায়গা নেই।’
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শিগগিরই আলোচনা করার তাগিদ দিয়ে নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বিষয়গুলো আগে থেকেই বলে আসছি। এখন একটি বড় ধাক্কা দিতে চাই।’ একদিকে অর্থনৈতিক অস্বস্তিতে থাকা, অন্যদিকে নিরাপত্তার অভাববোধ করার কথা জানান নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং কমাতে হবে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম।’ ব্যবসা খাতকে সহায়তা করে জীবনকে সহজতর করার আহ্বান জানান তিনি।
আমলাতন্ত্র প্রসঙ্গ
দ্বিতীয় অধিবেশনে অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, একজন ব্যক্তি বা একটি সরকার এতটা পরাক্রমশালী হতে পারে না যে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে। তাদের সমর্থনের পেছনে একটি শক্তিশালী ভিত্তি থাকে। সেই ভিত্তির মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি রয়েছে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী শ্রেণির একটি অংশ। সাবেক সরকারকে সমর্থন দেওয়া আমলাতন্ত্রের গঠনমূলক পরিবর্তন ছাড়া ভবিষ্যতে কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাও আমলাতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমলাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে নানাভাবে। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল, যারা অর্থ পাচার করেছে, দেশের ভেতরেও আছে তাদের টাকা। সেগুলো উদ্ধার করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে উন্নয়নের গালগল্প শোনানো হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।
উমামা ফাতেমা আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কী কী চুক্তি হয়েছে, তা আমাদের জানা দরকার। শোষণ করে আমাদের ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। সরকার এখনো এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়নি।’
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার দাবি
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন। এ অর্থ ফেরত আনতে বাজেটে ভালো বরাদ্দ রাখারও দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘অন্য দেশ পাচার অর্থ ফেরত আনতে পারলে আমরা কেন পারব না?’
সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান এ বিষয়ে বলেন, বিশ্বের কোন কোন দেশ পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছে, সেই উদাহরণ যেন তুলে ধরা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা শুধু ১৫ বছর নয়, তারও আগে থেকে আছে বলে মন্তব্য করে রওনক জাহান বলেন, নির্বাচনের আগে অনেকে প্রতিশ্রুতি দেন। পরে আর তাঁরা পারেন না। কারণ, কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীকে তারা উপেক্ষা করতে পারেন না।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী দুর্নীতির নেপথ্য কারণ তুলে ধরে বলেন, ‘সংসদ সদস্য (এমপি) হওয়ার জন্য ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয় অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জনের। আর একটা অংশ আছে যাদের ব্যয় হয় ১০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। আমার প্রশ্ন, এমপি হওয়ার জন্য এত আগ্রহ কেন?’ বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে এমপি নির্বাচনের বদলে শূন্য টাকায় নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা হলে ভালো ফল আশা করা যাবে বলে তিনি মনে করেন।
শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশা
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য সায়মা হক বিদিশা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবু ইউসুফ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য এম ফরিদউদ্দিন, পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ, ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উন্নয়ন সহযোগিতা প্রধান মিশেল ক্রিজা, বিশ্বব্যাংকের মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আমের আহমেদ প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শ্বেতপত্র কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন।
সেলিম রায়হান বলেন, শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়নি।