৩২ আসন ছাড়ল আওয়ামী লীগ

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের পর সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে (জাপা) সঙ্গী করেই ভোটে যাত্রা করল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনেও গতকাল রোববার ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ ও দেনদরবারের পর শেষ পর্যন্ত জাপা ভাগে পেল ২৬ আসন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী ১৪ দলের শরিকেরা পেয়েছে ৬টি আসন। আর আওয়ামী লীগের মনোনীত ৫ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। ফলে শরিকদের আসন ছাড়ার পর দলের ২৬৩ জন প্রার্থী নিয়ে ভোটের মাঠে নামল আওয়ামী লীগ।

বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপা ও ১৪ দলের শরিকদের মোট ৩২টি আসন ছাড়ল আওয়ামী লীগ। ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টিও নির্বাচনে আছে। এসব দলের কোনো কোনো নেতাকে জিতিয়ে আনা হতে পারে বলে আলোচনা আছে। এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। সব মিলিয়ে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি ভোটে অংশ নিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও জাপার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দুই সপ্তাহ ধরে চার-পাঁচ দফা গোপনে বৈঠক করেছেন। দুই দলই আসন সমঝোতার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

১৪ দলের তিন শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনটি এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি আসন ভাগে পেয়েছে। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ভোট করবেন। আর জাতীয় পার্টির সবাই তাঁদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে ১৪ দল ও জাপাকে কোন কোন আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ ও জাপার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দুই সপ্তাহ ধরে চার-পাঁচ দফা গোপনে বৈঠক করেছেন। দুই দলই আসন সমঝোতার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপা মিত্র নয়, আওয়ামী লীগের ‘জোটসঙ্গী’ হিসেবে ভোটে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া চিঠিতে আওয়ামী লীগ বলেছে, আওয়ামী লীগ দলগত ও জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে আগেই জানানো হয়েছে। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক কিংবা নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবে। জোট করার ফলে আওয়ামী লীগের কোন কোন প্রার্থী বাদ যাবেন এবং এর স্থলে জাপা, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও জেপির ৩২ জন প্রার্থী অন্তর্ভুক্ত হবে—এর তালিকাও সংযুক্ত করা হয় চিঠিতে।

এখন ভোটের মাঠে জাতীয় পার্টিই আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটের পর সংসদে অবস্থান ঠিক হবে।
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু)

অবশ্য জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু) প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জাপা কোনো জোটে নয়। এককভাবে নির্বাচন করছে। আওয়ামী লীগ কিছু আসনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। জাপা প্রত্যাহার করেনি। সংসদের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার দাবিদার কি জাপা থাকছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন ভোটের মাঠে জাতীয় পার্টিই আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ভোটের পর সংসদে অবস্থান ঠিক হবে।

বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেদের ভাগে রেখেছিল ২৪১টি আসন। বাকি ৫৯টি আসন শরিক ও মিত্রদের ছেড়ে দিয়েছিল। সেবার জাপা পেয়েছিল ৩৭টি আসন। আরও ৭টি আসন উন্মুক্ত রাখা হয়। আসন ভাগাভাগিতে ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা পেয়েছিল ১২টি আসন। এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ৩টি আসন পেয়েছিল। এবার তারা প্রকাশ্যে সমঝোতায় অংশ নেয়নি। এর আগে ২০১৪ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জাপা ও ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে একই ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচন করেছিল।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু প্রথম আলোকে বলেন, আসন ভাগাভাগি হলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। এতে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। কারণ, জাপাসহ বিভিন্ন দল নিজ প্রতীকে আরও অনেক আসনে ভোট করছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসবে।

তবে আওয়ামী লীগের অন্য সূত্রগুলো বলছে, সমঝোতার বাইরে থাকা অন্যান্য দলের প্রার্থীরা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারবেন না; বরং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশির ভাগ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন। দলটির ২৬৯ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

আসন ভাগাভাগি হলেও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। এতে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। কারণ, জাপাসহ বিভিন্ন দল নিজ প্রতীকে আরও অনেক আসনে ভোট করছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু

জোটকে আসন ছাড় ও প্রতিক্রিয়া

বিএনপিবিহীন ভোটেও এবার সবচেয়ে কম আসন ভাগে পেয়েছে ১৪ দলের শরিকেরা। এই জোটে আওয়ামী লীগের বাইরে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৭। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র তিনটি দল আসন ভাগে পেয়েছে।

সাতক্ষীরা-১ আসনের ওয়ার্কার্স পার্টির তিনবারের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এবার আসন সমঝোতার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। অবশ্য গত বৃহস্পতিবার ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন যে ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান তিন সংসদ সদস্য—রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা ও মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এবারও জোটের মনোনয়ন পাচ্ছেন। তবে রাশেদ খান ঢাকায় নয়, বরিশাল-২ আসন পেয়েছেন। কিন্তু শনিবার রাতে লুৎফুল্লাহকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফিরোজ আহম্মেদ ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এ ছাড়া জাপাকে সাতক্ষীরা-২ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলের একটা আসন কমে যাওয়া অপ্রত্যাশিত। এটা দুঃখজনক। তবে ১৪ দলের সঙ্গে সংগ্রামে ছিলাম, নির্বাচনে আছি।’

এবার জোটের আসন ভাগাভাগিতে আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম-২ আসনটি। তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী তিনবারের সংসদ সদস্য হয়েও এবার জোটের মনোনয়ন পাননি। এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার। ফটিকছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন হোসাইন মো. আবু তৈয়ব। আছেন সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন মাইজভান্ডারীও।

আমাদের দলের একটা আসন কমে যাওয়া অপ্রত্যাশিত। এটা দুঃখজনক। তবে ১৪ দলের সঙ্গে সংগ্রামে ছিলাম, নির্বাচনে আছি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন

নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তাঁর দলের প্রতীক ফুলের মালা নিয়ে ভোট করবেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে ভোট করার অনুরোধ করেছেন। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে ভোট করবেন তিনি।

এর বাইরে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। না পেয়ে গতকাল তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। দিলীপ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন।

জোটের ছাড়ে সংসদ সদস্য হয়েই বাদ

আফজাল হোসেন ও শাহজাহান আলম—এই দুজন আওয়ামী লীগের হয়ে গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন। তাঁরা যখন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন, তত দিনে একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশন হয়ে যায়। ফলে তাঁরা আর সংসদ কক্ষে বসতে পারেননি। জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের আসন ভাগাভাগিতে কপাল পুড়ল তাঁদের। আফজাল হোসেনের পটুয়াখালী-১ আসনটি পেয়েছেন জাপার কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার। আর শাহজাহান আলমের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন পেয়েছেন জাপার রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া।

গত ২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে। এতে ৭১ জন বর্তমান সংসদ সদস্য বাদ পড়েন। গতকাল আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার পর আরও ছয়জন বাদ পড়েন। সব মিলিয়ে বর্তমান সংসদের ৭৭ জন আওয়ামী লীগের সদস্য বাদ পড়লেন। সর্বশেষ আফজাল হোসেন ও শাহজাহান আলমের সঙ্গে আরও বাদ পড়েন কুড়িগ্রাম-১ আসনের আছলাম হোসেন সওদাগর, গাইবান্ধা-২ মাহবুব আরা বেগম গিনি, পটুয়াখালী-১ আফজাল হোসেন, ঢাকা-১৮ মোহাম্মদ হাবিব হাসান, চট্টগ্রাম-৮ নোমান আল মাহমুদ।

আসন ভাগাভাগি করে জাপা ও ১৪-দলীয় জোটের শরিকেরা ভোটে অংশ নিলেও তাদের এখনো দুশ্চিন্তা কাটছে না। কারণ, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এখনো রয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দল তাদের দলীয় প্রার্থী উঠিয়ে নিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে জোটের শরিকদের জয় নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, বিএনপিবিহীন এবারের নির্বাচনে ভোটার টানার জন্য ‘স্বতন্ত্র কৌশল’ নিয়েছেন তাঁরা। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো স্বতন্ত্র প্রার্থী সরিয়ে দিতে রাজি নন।