জেতার মতো প্রার্থী নেই, আনুকূল্য পেতেই ভোটে

গত ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৯টি ইসলামি দলের ১৪ জন নেতা দেখা করেনছবি: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সৌজন্যে

নিবন্ধিত সাতটি ইসলামি দল বা এই ধারার রাজনৈতিক দলের সাড়ে চার শর মতো প্রার্থী আগামী ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দলগুলো এত প্রার্থী দিলেও সরকারের সহায়তা বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় না পেলে তাঁদের একজনেরও ভোট করে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থা নেই মাঠে। কার্যত, দলগুলো সরকারঘনিষ্ঠ। তাদের ভোটে যাওয়ার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের আনুকূল্য পাওয়া।

ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে কেবল বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের গত দুটি সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। দলটির প্রধান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী একসময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থেকে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তিনি গত দুটি নির্বাচনের মতো (২০১৪ ও ২০১৮) এবারও চট্টগ্রাম-২ আসনে তরিকতের প্রার্থী।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাছাইয়ে তরীকত ফেডারেশনের ৪১ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নজিবুল বশরের আসনটি ছাড়া তরীকত থেকে আর কারও জয়ী হওয়ার মতো অবস্থা নেই এলাকায়। যদিও সুষ্ঠু ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন হলে নজিবুল বশরেরও জয় পাওয়া কঠিন। কারণ, তাঁরই ভাইয়ের ছেলে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদও এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন। দুজনেরই এলাকায় অনুসারী রয়েছে। একই পরিবারের দুই সদস্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমতে পারে।

এ ছাড়া এই আসনে আওয়ামী লীগ–মনোনীত প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তৈয়বও প্রার্থী হয়েছেন। তৈয়ব চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগ সমঝোতার স্বার্থে নিজেদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিলেও তৈয়ব স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে থেকে গেলে নজিবুলের জন্য চ্যালেঞ্জ আছে।

ইসলামী ঐক্যজোটের আশা
তরীকতের ফেডারেশনের বাইরে সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল ইসলামী ঐক্যজোটের (মিনার)। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে মুফতি ফজলুল হক আমিনী ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক ছিল ইসলামী ঐক্যজোট। এখন দলটি বিএনপির সঙ্গে নেই। এবারের নির্বাচনে তাদের ৩৬ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। আপিলে আরও চারজনের মনোনয়নপত্র বৈধ হবে বলে আশা করছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা।

দলটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁরা সরকারি মহল থেকে দুটি আসনের ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত পেয়েছেন। সেগুলো হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) ও কুমিল্লা-২ (হোমনা -মেঘনা) আসন। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আমিনী ও কুমিল্লা-২ আসনে যুগ্ম মহাসচিব আলতাফ হোসাইন প্রার্থী হয়েছেন। দুজনের সঙ্গে সরকারি মহলের বিশেষ যোগাযোগ বা সখ্য রয়েছে। তার ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনে গেছে। ওই সূত্রেই তাঁরা আসন সমঝোতার আশ্বাস পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

যদিও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন শাহজাহান আলম; যিনি সেই আসনের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর পর গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে জয়ী হন। শপথ নিলেও তিনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি। তার আগেই একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপ্তি হয়ে যায়। এবার তাঁকে বাদ দেওয়াটা কঠিন। অন্যদিকে কুমিল্লা-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিমা আহমাদ। তিনি নিটোল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর ছাড় দেওয়াটা কঠিনই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যে দুটি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তার একটি খেলাফত আন্দোলন। অন্যটি ইসলামী ঐক্যজোট। খেলাফত আন্দোলনের নয়জন প্রার্থীর মনোনয়ন টিকেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জয়ী হওয়া তো নয়ই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার মতো প্রার্থীও নেই দলটির। এর মধ্যে দলের আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী প্রার্থী হয়েছেন মুন্সিগঞ্জ-১ (শ্রীনগর-সিরাজদিখান) আসনে। ঢাকা-২ নির্বাচনী এলাকা কামরাঙ্গীরচরে নিজের এলাকা ছেড়ে তিনি কেন সেখানে প্রার্থী হলেন, তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে।

২১০ আসনে জাকের পার্টি
ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে এবারের নির্বাচনে সর্বাধিক প্রার্থী দিয়েছে জাকের পার্টি (গোলাপ ফুল)। তাদের ২১০ জনের মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। তবে দলটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো একটি আসনই আছে। সেটি ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, সদর ও চরভদ্রাসন) আসন। সেখানে দলের প্রধান মোস্তফা আমীর ফয়সল অতীতে নির্বাচন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েন। এবার তিনি প্রার্থী হননি। এ ছাড়া জেতার বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার মতো দলটির আর কোনো প্রার্থী নেই। শুধু দলীয় প্রচার ও প্রসারের জন্য জাকের পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেছেন দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সায়েম আমীর ফয়সল।

জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দারও মুন্সিগঞ্জ-৩ (সদর ও গজারিয়া) আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুবিধার জন্য আমরা কখনো নির্বাচন করিনি। আমাদের দৃষ্টি ২০২৮ ও ২০৩৩ সালের নির্বাচনের দিকে। এখন থেকেই আমরা সে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিস্থিতি দেখব। সন্তুষ্ট না হলে ভিন্ন চিন্তা করব।’

এর বাইরে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (চেয়ার), বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট (মোমবাতি) নির্বাচন করছে। একটি দল ভেঙে এ দুটি দল হয়েছে। এর মধ্যে মোমবাতি প্রতীক নিয়ে দুটি আসনে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ও চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) প্রার্থী হয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন। এর মধ্যে  পটিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও ফটিকছড়িতে প্রয়াত আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার প্রার্থী হয়েছেন। তা ছাড়া ফটিকছড়িতে নজিবুল বশর সরকারঘনিষ্ঠ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক দল তরীকত ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে আসনটি ছাড় দেওয়া হতে পারে।

ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের ৩৯ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। এই দলের চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি) আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চারবারের সংসদ সদস্য, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। এই আসনে সমঝোতা করাটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

তবে বাহাদুর শাহ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আশা রাখি কিছু একটা হবে। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।’