বাবার কবরে তারেকের নীরব, নিঃশব্দ অশ্রুসজল শোক
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে দীর্ঘ ১৯ বছর পর ছেলে তারেক রহমানের শ্রদ্ধা নিবেদন।
কোনো বক্তব্য নয়, কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়—শুধু নিঃশব্দ শোক। দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরার পরদিনই গতকাল শুক্রবার বিকেলে নিজের বাবা, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি একান্তে কিছু সময় কাটান এবং মোনাজাত করেন। পরে দলের নেতাদের নিয়েও সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তারেক রহমান। তখন তিনি ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। এরপর কেটে গেছে ১৯ বছর। যার মধ্যে ১৭ বছরই নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে।
গ্রেপ্তার, নির্যাতন, কারাগারে যাওয়া, নির্বাসন, ভাইয়ের মৃত্যু, মায়ের কারাবন্দী হওয়া, মায়ের অসুস্থতাসহ ব্যক্তিগত জীবনের নানা ধাপ পেরিয়ে দীর্ঘ ১৯ বছর পর সমাধি প্রাঙ্গণে এসেই অশ্রুসজল হয়ে পড়েন তারেক রহমান। চশমা খুলে চোখ মুছে নীরবে তিনি যখন সমাধির সামনে দাঁড়ালেন, তখন একটু দূরে ভিড় করা নেতা-কর্মীরাও ছিলেন অশ্রুসজল।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৫ সালে লন্ডনে নির্বাসনে থাকাকালে ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে হারান তারেক রহমান। মায়ের পাশাপাশি তাঁরা দুই ভাই ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তারেক রহমান যুক্তরাজ্য এবং আরাফাত রহমান মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১৫ মাস পর গত বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) যখন তারেক রহমান দেশে ফেরেন, তখন তাঁর মা বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
দেশে ফেরার পর লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার পূর্বাচলে জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়েতে তারেক রহমানকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি যান এভারকেয়ার হাসপাতালে মাকে দেখতে।
সড়কে নেতা-কর্মীদের ভিড়
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল বাদ জুমা শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে আসার কথা ছিল তারেক রহমানের। বেলা ২টা ৫২ মিনিটে তারেক রহমানের গাড়িবহর গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে সমাধিস্থলের পথে রওনা দেয়। বৃহস্পতিবার বুলেটপ্রুফ যে বাসে (লাল-সবুজ পতাকার রঙে সাজানো) করে তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলে এসেছিলেন, সেই বাসে করেই তিনি শেরেবাংলা নগরে যান। বৃহস্পতিবার তারেক রহমানকে ঘিরে যে কড়া নিরাপত্তা দেখা গিয়েছিল, গতকালের চিত্রও ছিল একই রকম।
গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তারেক রহমানের গাড়িবহর যখন বিজয় সরণি এলাকায় এসে পৌঁছায়, তখনই সড়কের দুই পাশে অবস্থানরত দলটির বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী রাস্তায় নেমে এসে তারেক রহমানকে অভিবাদন জানান। তিনি বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছা জানান। নেতা-কর্মীদের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে একপর্যায়ে তারেক রহমানকে বহন করা বাস আর সামনে এগোতে পারছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নেতা-কর্মীদের সড়ক থেকে সরাতে হিমশিম খান। বিজয় সরণি পেরিয়ে জিয়া উদ্যানে প্রবেশের আগে সড়কে অবস্থান করা নেতা-কর্মীদের ভিড়ে বাসের যাত্রা প্রায় থেমে যায়। নেতা-কর্মীদের সরাতে বাধ্য হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লাঠিপেটা পর্যন্ত করতে হয়েছে। বাস ঘিরে কর্মী-সমর্থকদের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে গুলশান থেকে জিয়া উদ্যান পর্যন্ত আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় পৌনে দুই ঘণ্টা।
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জিয়া উদ্যান থেকে পথে পথে নেতা-কর্মীদের ভিড়ের কারণে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে তারেক রহমানের গাড়িবহরের সময় লেগেছে পাঁচ ঘণ্টা।
পরে বিকেল ৪টা ৩৬ মিনিটে বাস থেকে নেমে সমাধিস্থলের উদ্দেশে হেঁটে রওনা দেন তারেক রহমান। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তারেক রহমানের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ, সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো শেষে সমাধি প্রাঙ্গণে মোনাজাত করেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন
বিকেল ৫টা ৪ মিনিটে তারেক রহমান বাসে চড়ে জিয়া উদ্যান থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা হন। সাভার যাওয়ার সময়ও সড়কের দুই পাশে অবস্থান করা হাজারো মানুষ তারেক রহমানকে অভিবাদন জানান। তিনিও বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। ততক্ষণে সূর্যাস্তের সময় হয়ে আসে।
সূর্যাস্তের আগে তারেক রহমান কোনোভাবেই সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারবেন না, সেটি বুঝতে পারায় বিকেল ৫টা ৬ মিনিটে তারেক রহমানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির নেতারা।
অবশ্য জাতীয় স্মৃতিসৌধে সূর্যাস্তের আগে শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি লিখিত কোনো আইন নয়। এটি মূলত রাষ্ট্রীয় একটি ‘প্রটোকল’। সামরিক ঐতিহ্য ও ব্যবস্থাপনাগত বাস্তবতা থেকে গড়ে ওঠা প্রচলিত একটি নিয়ম।
স্মৃতিসৌধে তারেক রহমানের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পথে পথে নেতা-কর্মীদের ভিড়ের কারণে তারেক রহমানের গাড়িবহর জিয়া উদ্যান থেকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা। গাড়িবহর জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছায় গতকাল রাত ১০টা ৫ মিনিটে। পরে তিনি গাড়ি থেকে নেমে বিএনপি নেতাদের নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে তিনি এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এরপর তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইয়ে সই করেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তারেক রহমানের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার জানান, জাতীয় স্মৃতিসৌধে তারেক রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে গতকাল দুপুর থেকেই সেখানে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী অবস্থান নেন। তাঁরা তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগান দেন। এ ছাড়া গাবতলী থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দুই পাশে বিভিন্ন পয়েন্টে (স্থান) হাজারো মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তারেক রহমানকে অভিবাদন জানান।
‘নতুন আশার সঞ্চার’
জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এসেছে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ছিল রাজকীয় ও অভূতপূর্ব। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন এবং আনন্দ-উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব কম নেতার পক্ষেই এমন স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন ও গণ–অভ্যর্থনা পাওয়া সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, তরুণ ও সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব হিসেবে তারেক রহমানকে আজ দেশের মানুষ শুধু নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখছে।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে এখন সুবাতাস বইতে শুরু করেছে’ উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা শুধু একটি ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তন নয়; এটি দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের পথ আরও সুগম হবে।