ভোটকেন্দ্রে ‘ডাকাত’: সাংবাদিকেরা কি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন

নির্বাচন কমিশন ভবন
ফাইল ছবি

ভোটের গোপন কক্ষে ‘ডাকাত’ থাকে—এ বক্তব্য ছিল খোদ নির্বাচন কমিশনের। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের প্রশ্নে সেই ‘ডাকাত’ দূর করার কৌশল ঠিক করার কথা বলেছিলেন। সেটা বলেছিলেন গত জুনে একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। এরপর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সিইসি নিজে ভোটকক্ষে ‘ডাকাত’ দেখেছিলেন। সামনের নির্বাচনগুলোতেও যদি ভোটকেন্দ্রে ডাকাত দেখতে পান, তখন সাংবাদিকেরা কী করবেন? ছবি, ভিডিও করে সেটা তাঁর পাঠক–দর্শকদের সামনে তুলে ধরবেন? কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা বলছে, সেটা করা যাবে না। এমনকি ভোটকক্ষে ১০ মিনিটের বেশি অবস্থানও করতে পারবেন না সংবাদকর্মীরা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন যে নীতিমালা দিয়েছে, তাতে ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন কঠিন করে দেওয়া হচ্ছে। ‘ডাকাত’ বা বহিরাগত ব্যক্তি ভোটকক্ষে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে; চোখের সামনে অনিয়ম হবে, কিন্তু সাংবাদিক ছবি তুলে প্রমাণ রাখতে পারবেন না।

ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকের চোখ যদি খোলা থাকে, তা কিন্তু নির্বাচন কমিশনকেই সহায়তা করবে। একেক সাংবাদিকের একেকটা ক্লিক–ভিডিও ঘটনার প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। অতীতে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালও ‘ডাকাত’ ধরতে সাংবাদিকের কাছে ছবি চেয়েছিলেন। গত বছরের জুন মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেছিলেন, ডাকাতের ছবি তুলে আনতে পারলে ওই কেন্দ্রের ভোট বাতিল করা হবে। সেই সংবাদ সম্মেলনেই তিনি সাংবাদিকদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গোপন ভোটকক্ষে কয়টা ডাকাত পেয়েছেন?’ জবাবে এক সাংবাদিক জানিয়েছিলেন, তিনটি ছবি প্রকাশ পেয়েছে। তখন সেসব ছবি দেওয়ার জন্য বলেছিলেন সিইসি।

গত বছরের ২২ জুন ওই সংবাদ সম্মেলনে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘আমাদের কমিশনার আহসান হাবীব খান বলেছিলেন, ওখানে (গোপন ভোটকক্ষে) একজন ডাকাত থাকে। আমি জানতাম না যে একজন ডাকাত থাকে। এখন যেহেতু জেনেছি, আমরা কীভাবে এটা ওভারকাম করব, সেই কৌশল নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করেছি।’

তবে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান ভোটের গোপন কক্ষে ডাকাতের ঢোকার কথা বলেছিলেন গত বছরের মে মাসে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোটের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সাংবাদিকের প্রশ্নে এই নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, ‘ইভিএমের মধ্যে চ্যালেঞ্জ একটাই, সেটা হচ্ছে, ডাকাত–সন্ত্রাসী গোপন কক্ষে একজন করে দাঁড়িয়ে থাকে, “আপনার ভোট হয়ে গেছে চলে যান।” দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।’
এরপরও এখন সাংবাদিকের নির্বাচনকালে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে অতিমাত্রায় বিধিনিষেধ বলা যেতে পারে। এসব নীতিমালা নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

সাংবাদিককে শুধু নীরবে পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে?

ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষ, যেখানে একজন ভোটার তাঁর অধিকার প্রয়োগ করেন। অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই ওই গোপন কক্ষে। জাতীয় নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের খবর সংগ্রহের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাংবাদিকেরা কখনো গোপন কক্ষে ঢোকেন না। সেখানে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার ছবি সাংবাদিকেরা কখনোই তোলেন না।

প্রশ্ন হচ্ছে, গোপন কক্ষে অনিয়ম ঘটলে তখন সাংবাদিকেরা কি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন? এবারের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘কোনোক্রমেই গোপন কক্ষের ভেতরের ছবি ধারণ করতে পারবেন না।’ এর মানে কি গোপন কক্ষে ‘ভোটডাকাত’ ঢুকে পড়লে বা ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে সেটার ছবি না তুলে সাংবাদিককে শুধু নীরবে পর্যবেক্ষণ করে যেতে হবে?

সাংবাদিককে নীরব দর্শক বানানোর এই নীতিমালা এমন এক সময় আনা হলো, যখন নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ ও বিতর্ক বেড়ে চলেছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক চলমান। এমনকি গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে সিইসি অন্য নির্বাচন কমিশনার ও সাংবাদিকদের নিয়ে সিসি ক্যামেরায় ওই ভোট গ্রহণের পরিস্থিতি দেখছিলেন। একপর্যায়ে ক্যামেরায় ভোটের গোপন কক্ষে ‘ডাকাত’ দেখতে পেয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অনেককে একসঙ্গে ভোট দিতে দেখছেন। এরাই ডাকাত। এরাই দুর্বৃত্ত।

মোটরসাইকেল কি নিষিদ্ধ বাহন

নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকেরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশনের নীতিমালায় এটি একটি বড় শর্ত। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম এই নীতিমালা নিয়ে। তাঁরা ঠাট্টা করে বলছিলেন, কোনো এক অদ্ভুত খেয়ালে নির্বাচন কমিশন এই নিয়মের কথা বলে থাকতে পারে। মাঠের বাস্তবতা কতটা বিবেচনা করা হয়েছে—এ প্রশ্ন রয়েছে পর্যবেক্ষকদের।
কারণ, সাংবাদিকেরা কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে বসে থাকতে পারেন না। কোনো খবর পাওয়ার পর তাঁদের দ্রুত ছুটতে হয় এক ভোটকেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে।

রাজধানী ঢাকায় সাংবাদিক বা ফটোসাংবাদিকদের একটা বড় অংশ ভোটের দিনে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে মোটরসাইকেল। আর ঢাকার বাইরে জেলা–উপজেলায় বেশির ভাগ সাংবাদিকই নির্ভর করেন মোটরসাইকেলের ওপর। এ ছাড়া দুর্গম অনেক এলাকার ভোটকেন্দ্রে মোটরসাইকেল ছাড়া দ্রুত যাওয়া সম্ভব হয় না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা দুর্গম এলাকায় অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র থাকে। এ ধরনের কেন্দ্রের খবর সংগ্রহের জন্য যেতে সাংবাদিকদের একমাত্র অবলম্বন মোটরসাইকেল।

এমন বাস্তবতায় নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কতটা যৌক্তিক? আর মোটরসাইকেলে সমস্যাটা কোথায়, সেটার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। দেশে মোটরসাইকেল কোনো নিষিদ্ধ যানবাহন নয় যে সাংবাদিকেরা এটি ব্যবহার করলে অপরাধ হবে। তবে কি নির্বাচন কমিশন এটা চাইছে না যে সাংবাদিকেরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাক এবং অনিয়মের খবর প্রকাশ করুক?

নীতিমালা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে

নির্বাচন কমিশনের এই নীতিমালায় সাংবাদিকদের জন্য আরও অনেক বিধিনিষেধ আনা হয়েছে, যেগুলো একটা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কথাই বলছে।

ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তা, এজেন্ট বা ভোটারের বক্তব্য নেওয়া যাবে না। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, কোনো একজন প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বা জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। এরপর ওই প্রার্থীর এজেন্ট সেজে প্রতিপক্ষের লোক বুথে বসে আছেন। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করে বা কথা বলে জানতে পারেন, সেখানে কোনো সাজানো এজেন্ট আছেন কি না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, লাইনে ভোটার নেই বা সকাল থেকে কেন্দ্র ফাঁকা; কিন্তু ব্যালট বইয়ে পাতা শেষ। সেটাও জানার উপায় হচ্ছে ভোটকক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে, জিজ্ঞাসা করে। এখন সেটাও বন্ধ করতে চাইছে।

ভোটকেন্দ্রে ঢোকার পর প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জানিয়ে ভোট গ্রহণ কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ করা যাবে। কোনো আদর্শ পরিস্থিতিতে এ ধরনের নিয়মের কথা বলা যেতে পারে। দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় সে ধরনের আদর্শ পরিবেশ কি আছে?

এখানে প্রশ্ন থাকে, কোনো ভোটকেন্দ্রে কারচুপির খবর পেয়ে সাংবাদিক যখন সেখানে যাবেন, তখন অনুমতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ বা ছবি তোলার জন্য কি তিনি অনুমতির অপেক্ষা করতে থাকবেন। এ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটলে সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কি অনিয়মের খবর সংগ্রহের অনুমতি দেবেন?

এমনিতে সাংবাদিকদের নানা চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। ‘ভোটডাকাতদের’ বাধা, হামলার উদাহরণ তো আছেই। ক্ষেত্রবিশেষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেখা গেছে।

এখন দেশে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে বিরোধ থেকে রাজপথে আন্দোলন করছে। সেই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা আসছে। নির্বাচন কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায়, এসব আলোচনা এখন চলছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের প্রতিও আস্থার অভাবের কথা বলছে।

কিন্তু এমন পটভূমিতে সাংবাদিকদের জন্য নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে নির্বাচন কমিশন যে নীতিমালা দিয়েছে, তা আরেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এর লক্ষ্য যে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করা, সেটা অনুমান করাই যায়।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ভোটকেন্দ্রের খবর সংগ্রহের জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তার অনুমতি নেওয়াসহ নতুন নীতিমালার বেশির ভাগ অনেক আগে থেকেই বিধান হিসেবে রয়েছে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, নীতিমালা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এটি নিয়ে তাঁরা আরও আলোচনা করবেন। তাতে আলোচনা-সমালোচনা বা মতামত যা আসবে, তা পরীক্ষা করে প্রয়োজনে সংশোধন করা যেতে পারে।

তবে নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে নির্বাচন কমিশন বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন আরএফইডির সঙ্গে কমিশনের আলোচনা করার কথা ছিল। সংগঠনটি কয়েক দফা দাবিও দিয়েছিল। কিন্তু নীতিমালা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেনি কমিশন।

এ ছাড়া সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। বড় পরিসরে সাংবাদিক নেতৃত্ব বা প্রতিনিধিদের সঙ্গেও এ নীতিমালা নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি বলেই অভিযোগ উঠেছে।

যদিও একাধিক নির্বাচন কমিশনার প্রথম আলোকে বলেছেন, নীতিমালা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে তাঁরা সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করতে পারছে না বলে মনে হয়। আসলে সাংবাদিকদের উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে কি না, সে সন্দেহ থেকে এ উদ্বেগ কাটছে না।