যেসব আসনে দলের পুরুষ প্রার্থীদের জয় পাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানেই নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর হেরে গেলে পুরুষ নেতারা বলেন, ‘মহিলারা পারে না।’ তৃণমূলে কাজ করলেও স্থানীয় পুরুষ নেতারা দলীয় মনোনয়নে নারীদের নাম সুপারিশ করেন না। দলে কোনো ভূমিকা না থাকলেও নেতাদের স্ত্রী, কন্যারা মনোনয়ন পান।
রাজধানীতে আজ সোমবার ‘নির্বাচনে নারী নেতৃত্বের অগ্রগতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির সাবেক নারী সংসদ সদস্য ও নেতারা। বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) এই সভার আয়োজন করে। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা প্রশ্ন তুললে বিতর্কও হয়। অনুষ্ঠান আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল ইউএসএআইডি।
সভায় বলা হয়, মনোনয়নপ্রাপ্ত পুরুষের চেয়ে মনোনয়নপ্রাপ্ত নারীদের জয়ের হার আড়াই গুণ বেশি।
অনুষ্ঠানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, হেরে যাওয়ার মতো আসনে নারীদের মনোনয়ন দেয় দলগুলো। এভাবে দলগুলো নারী প্রার্থীদের সংখ্যা বেশি দেখায়। তবে এখন সুষ্ঠু নির্বাচন অনিশ্চিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে মনোনয়ন চাইব কি না, ভাবতে হবে। ২০০৮ সালের পর যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে, তাতে মনোনয়ন চাওয়ার আগ্রহ চলে গেছে।’
জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান ওই সময় বলেন, ‘আপনি আগে দলের কাছ থেকে মনোনয়ন নিন, তারপর দেখেন নির্বাচন হয় কি না।’
এই বিতর্কে অংশ নিয়ে সংরক্ষিত আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হেলেন জেরিন খান বলেন, ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে চাই, আমরা মনোনয়ন পেয়েছিলাম। নির্বাচনের যে কী অবস্থা, তা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। সারা বিশ্ব দেখেছে।’ তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং এই নির্বাচনে দলগুলোকে ৫০ শতাংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে।
কাজ করেও মনোনয়ন পাওয়া যায় না
নারী নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রতিযোগিতায় তাঁরা হেরে যান। মনোনয়ন পেতে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে তৃণমূলে বছরের পর বছর ধরে কাজ করলেও তাঁদের বিষয়ে স্থানীয় জ্যেষ্ঠ নেতারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সুপারিশ করেন না। অনেক সময় নেতারা নিজেরাই বাধা হয়ে দাঁড়ান।
জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদা রহমান মুন্নি বলেন, নির্বাচনে নারীরা অংশ নেওয়ার সুযোগই পান না। ভূরি ভূরি পুরুষ হারছেন, তাতে কিছু হয় না। নারীরা হারলেই কথা শোনানো হয়। অর্থ দিয়ে মনোনয়ন কেনা হয়।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন জানান, তিনি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত নেতার কাছ থেকেও বাধার শিকার হয়েছেন। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থী হতে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এলাকার কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগে ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য হয়েছেন আমেনা কোহিনূর আলম। তিনি জানান, দল থেকে মনোনয়ন চেয়েও কখনো পাননি। তাঁর মতে, ছাত্রাবস্থা থেকে তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নারীদের কাজের কথা তুলে ধরে গণমাধ্যম নারীদের দলের মনোনয়ন পেতে সহযোগিতা করতে পারে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, যাঁদের মাথার ওপর ছাতা নেই, তাঁরা মনোনয়ন পান না। বউকে, মেয়েকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নীলফামারী জেলা শাখার কার্যকরী সদস্য সরকার ফারহানা আখতার বলেন, নীলফামারী–১ আসনের মানুষ জানেন তিনি কতটা নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু দলীয় মনোনয়নে তাঁর নাম কখনো সুপারিশে আসেনি।
যোগ্য নারীদের মনোনয়ন দিতে হবে
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক হিসেবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে মেয়েরা এখনো পিছিয়ে আছেন। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়েরা সাম্য অর্জন করতে পারছেন না। তৃণমূল পর্যায় থেকে নিজেদের দক্ষ ও যোগ্য করে তুলেছেন, এমন আরও বেশিসংখ্যক নারীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ওয়াসেকা আয়েশা খান বলেন, সব রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য শেরীফা কাদের বলেন, নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে চান। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে নারীদের।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্যে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ডানা এল ওল্ডস বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৫১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নারী। তাই নারীর কণ্ঠের গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেখা গেছে, মনোনয়নপ্রাপ্ত পুরুষদের তুলনায় মনোনয়নপ্রাপ্ত নারীদের জয়ের হার আড়াই গুণ বেশি। ওই নির্বাচনে ১ হাজার ৭৭৯ জন পুরুষ মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং জয়ী হন ২৩০ জন। জয়ের হার প্রায় ১৩ শতাংশ। নারীদের মধ্যে ৬৯ জন মনোনয়ন পান এবং জয়ী হন ২৩ জন। জয়ের হার ৩২ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্য দেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি চিফ অব পার্টি লেজলি রিচার্ডস। সভা সঞ্চালনা করেন সংস্থার পরিচালক (নারী ও যুব কার্যক্রম) লিপিকা বিশ্বাস।