উপজেলা নির্বাচনে উত্তরাধিকার বসাতে মরিয়া মন্ত্রী–সংসদ সদস্যরা 

তিন ধাপে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের ৫২ জন সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজন প্রার্থী রয়েছেন। শাস্তি দেওয়ার প্রশ্নে দলের শীর্ষ পর্যায়ে নমনীয়তার ইঙ্গিত।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনপ্রতীকী ছবি

দলীয় নির্দেশ অমান্য করে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের অনেকে উপজেলায় উত্তরাধিকার বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনের তিন ধাপেই তাঁদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের ৫২ জন প্রার্থী রয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, সংসদ সদস্যদের অনেকে ক্ষমতা নিজের হাতে ধরে রাখতে সন্তান বা নিকটাত্মীয়দের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন।

স্বজনেরা ভোট থেকে সরে না দাঁড়ালে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগ। শেষ পর্যন্ত স্বজনদের ঠেকানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এমন বাস্তবতায় শাস্তি দেওয়ার প্রশ্নে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে কিছুটা নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম তিন ধাপে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের অন্তত ৫২ জন স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় ধাপের মনোনয়নপত্র জমা শেষ হয়। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় ধাপেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ১৮ জন স্বজন প্রার্থী হয়েছেন। তিন ধাপের নির্বাচনে অন্তত নয়জন সন্তান চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। একজনের বাবা ও একজনের স্ত্রী প্রার্থী হয়েছেন। ১৩ জন আপন ভাই চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। বাকিরা সম্পর্কে চাচা, চাচাতো ভাই, ভাতিজা, শ্যালক ও ভগ্নিপতি। 

স্বজন বলতে আওয়ামী লীগ এখন যে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের অন্তত নয়জনের সন্তান এবং একজনের স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কতটা কঠোর হতে পারবে, দলটির ভেতরেই সেই আলোচনা রয়েছে।

স্বজনের সংজ্ঞা নিয়ে শুরুতে আওয়ামী লীগের নির্দেশনায় ধোঁয়াশা ছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিকটাত্মীয় হিসেবে সন্তান ও স্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, স্বজন বলতে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে সন্তান ও স্ত্রীকে বুঝিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী তা পরিষ্কারভাবে বলেছেন।

■ তিন ধাপের নির্বাচনে অন্তত নয়জন সন্তান চেয়ারম্যান প্রার্থী।

■ প্রার্থী আছেন একজন সংসদ সদস্যের বাবা ও আরেকজনের স্ত্রী।

■ প্রার্থী হওয়ায় এগিয়ে ভাইয়েরা; শ্যালক, চাচাতো ভাই, ভাতিজার তালিকা দীর্ঘ।

■ দুজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

কিন্তু স্বজন বলতে আওয়ামী লীগ এখন যে পরিবারকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতেও দেখা যাচ্ছে মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের অন্তত নয়জনের সন্তান এবং একজনের স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কতটা কঠোর হতে পারবে, দলটির ভেতরেই সেই আলোচনা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির কেন্দ্রীয় একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, শাস্তির প্রশ্নে দলের নেতাদের বক্তব্যে কিছুটা নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ সদস্যরা রাজনীতি করেন। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যকে ভোট করতে বাধা দেবেন কীভাবে? আসলে দলের স্থানীয় অন্য নেতারাও যাতে সুযোগ পান, সে জন্যই ওই সব নির্দেশনা এসেছিল। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, স্বজনদের ভোট করতে না দেওয়ার ব্যাপারে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে কখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মৌখিকভাবে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

ওবায়দুল কাদেরের ভাইও প্রার্থী

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বিবৃতি ও বক্তৃতা দিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই শাহদাত হোসেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন।

উপজেলা নির্বাচনে নিজের ভাইয়ের প্রার্থী হওয়া নিয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার স্বজনও একজন প্রার্থী হয়েছেন, আমার নিজের উপজেলায়। সেখানে প্রশ্নটা হচ্ছে, আমার এই প্রার্থিতার পেছনে সমর্থন আছে কি না, সম্মতি আছে কি না, আমি তাঁর পক্ষে প্রশাসন বা নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছি কি না। আমার দলের এর সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। আমার সমর্থন তো প্রশ্নই ওঠে না।’

সংসদ সদস্যরা রাজনীতি করেন। রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যকে ভোট করতে বাধা দেবেন কীভাবে? আসলে দলের স্থানীয় অন্য নেতারাও যাতে সুযোগ পান, সে জন্যই ওই সব নির্দেশনা এসেছিল।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম

তিন ধাপেই সন্তানেরা প্রার্থী

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্বজন বলতে এখন সুনির্দিষ্টভাবে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সন্তানের কথা জানানো হয়েছে। প্রথম তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচনেই দেখা গেছে, নিজের সন্তানকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়েছেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা।

প্রথম ধাপের ভোট ৮ মে। এই ধাপে মাদারীপুর সদরে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন আসিবুর রহমান খান। তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য শাজাহান খান। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী ও বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। হাতিয়ায় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশিক আলী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ প্রার্থী। রাকিবুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। 

পাবনার ভাঙ্গুরায় সংসদ সদস্য মো. মকবুল হোসেনের বড় ছেলে গোলাম হাসনায়েন আছেন ভোটের মাঠে। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের ছেলে সাইফুল আলমও চেয়ারম্যান প্রার্থী।

তৃতীয় ধাপে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আনিসুর রহমান রিয়াদ চেয়ারম্যান প্রার্থী। কুমিল্লার মুরাদনগরে সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ছেলে আহসানুল আলম সরকার চেয়ারম্যান প্রার্থী। তিনি বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান। 

টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। সে কারণে মন্ত্রী–এমপিরা এলাকায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পরিবারের সদস্যদের ভোটে নামিয়েছেন। এতে দলটির ভেতরে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। উপজেলা ভোটেও সংঘাতের আশঙ্কা থাকে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক বদিউল আজম মজুমদার

প্রার্থী হওয়ায় এগিয়ে ভাইয়েরা

স্বজনদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আপন ভাইয়েরা এগিয়ে রয়েছেন। পাবনার বেড়া উপজেলায় বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর দুজন আত্মীয় নির্বাচন করছেন। তাঁরা হলেন তাঁর আপন ছোট ভাই মো. আবদুল বাতেন ও আরেক ভাইয়ের ছেলে আবদুল কাদের। আবদুল বাতেন বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই এস এম নূর ই আলম নাজিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা নজরুল মজিদ মাহমুদ চেয়ারম্যান প্রার্থী। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ প্রার্থী হয়েছেন। মাহবুবুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাই গোলাম সারওয়ার চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায়। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদের ভাই নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন।

শ্যালক, চাচাতো ভাই, ভাতিজার তালিকা দীর্ঘ 

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলামের চাচা সফিকুল ইসলাম ও চাচাতো ভাই আলী আফসার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। 

কুষ্টিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হারুন অর রশীদ প্রার্থী হয়েছেন। 

মাদারীপুর সদর উপজেলায় সংসদ সদস্য শাজাহান খানের চাচাতো ভাই সাবেক চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী। খাগড়াছড়ির রামগড়ে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কারবারী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার জামাতা। এ ধরনের স্বজনের প্রার্থী হওয়ার সংখ্যই বেশি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক বদিউল আজম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। সে কারণে মন্ত্রী–এমপিরা এলাকায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতে পরিবারের সদস্যদের ভোটে নামিয়েছেন। এতে দলটির ভেতরে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। উপজেলা ভোটেও সংঘাতের আশঙ্কা থাকে।


[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা]