সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ ও মৎস্য ভবন হয়ে এই মিছিল প্রথমে হাইকোর্ট-সংলগ্ন শিক্ষা ভবনের সামনে ও পরে জিরো পয়েন্টে পুলিশের বাধার (ব্যারিকেড) মুখে পড়ে। দুই জায়গাতেই ব্যারিকেড ভেঙে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। তখন গুলিস্তান এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সড়কে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল বেলা আড়াইটার দিকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যায়। বেলা তিনটার দিকে তাঁরা বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে আবার গুলিস্তানে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচিতে ফিরে আসেন। সেখানে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক (এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক) নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘স্মারকলিপিতে আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪ ঘণ্টার একটি সুপারিশ করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদের অধিবেশন ডেকে আমাদের এক দফা দাবি বাস্তবায়নে আইন পাসের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক অথবা অধিবেশন আহ্বান করা হোক।’
আরেক সমন্বয়ক (এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা) সারজিস আলম বলেছিলেন, স্মারকলিপিতে সরকারি চাকরিতে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে সংসদে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
সেদিন জেলা পর্যায়েও গণপদযাত্রা করে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়ে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে ডিসিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন তাঁরা।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ২৪ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন প্রসঙ্গে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে।’ তাঁর এই মন্তব্যের প্রতিবাদে সেদিন রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে আসেন এবং মিছিল বের করেন। মিছিলে স্লোগান ওঠে ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে রাজাকার/ সরকার-সরকার’, আবার কেউ কেউ স্লোগান দেন, ‘কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’।
সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন হাজারো শিক্ষার্থী। তাঁরা কিছুক্ষণ পরপর স্লোগান দেন ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পর রাত তিনটায় ক্যাম্পাসে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ।
ওই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা (এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা) আকরাম হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন রাতে ছাত্রীদের অনেকে থালা-বাটি-চামচ নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা থালা-বাটি বাজিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। যেসব ছাত্রী কখনো রাজনীতি করেননি, তাঁদেরও সেদিন রাতে স্লোগান দিতে দেখেছিলাম। সেই দৃশ্য দেখেই মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনার ক্ষমতার সময় শেষ হয়ে আসছে।’