সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন খুলনা

বাসের পর লঞ্চ চলাচলও বন্ধ। গতকাল দিনভর সরকারি দলের মহড়া। রাতেই সমাবেশস্থলে হাজির বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মী।

মোটরসাইকেলের আরোহীর গতিপথ রোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন শ্রমিক লীগের একজন কর্মী। গতকাল বিকেলে বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়কের বারাকপুরে
ছবি: ইনজামামুল হক

বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন বিভাগীয় শহর খুলনাকে সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। দুই দিন আগে থেকে সড়কপথে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর গতকাল শুক্রবার থেকে নদীপথে লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দিলে খুলনা মহানগর অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। নগরের ভেতরেও যানবাহন খুব একটা চলেনি। লাঠিসোঁটা নিয়ে দিনভর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে রাস্তায় রাস্তায়। বিকেলে শিববাড়ী মোড়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ বড়সড় সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সব মিলিয়ে খুলনাজুড়ে উত্তেজনা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

এদিকে সড়ক ও জলপথে বাধার মুখেও গণসমাবেশের এক দিন আগেই আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী খুলনায় প্রবেশ করেছেন। কেউ হেঁটে, ট্রলারে চেপে, ট্রেনে চড়ে, অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে চেপে খুলনায় ঢুকেছেন। তাঁদের কেউ আত্মীয়স্বজনের বাসায়, কেউবা মেস ও হোটেলে উঠেছেন। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে সমাবেশস্থল সোনালী ব্যাংক চত্বরে জড়ো হতে দেখা গেল। তখন মঞ্চ নির্মাণের সরঞ্জামবাহী ট্রাক সমাবেশস্থলে ঢুকছিল।

এর আগে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে বিএনপির গণসমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে বাধা এসেছিল। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের সমাবেশে আসার পথে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত হামলা ও বাধার ঘটনা ঘটে। ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহের সমাবেশের দিন সড়কপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় বিভাগীয় সমাবেশ হচ্ছে আজ খুলনায়। এই সমাবেশের আগের দিন সড়ক ও জলপথে যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সাধারণ মানুষকেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

সমাবেশ বানচাল করতে খুলনা বিভাগজুড়ে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক শামসুজ্জামান। গতকাল খুলনার কে ডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাসের পর লঞ্চ ও ট্রলার চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাহলে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বাগেরহাট, নড়াইল থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি পায়ে হেঁটে আসবেন? এ কেমন মানসিকতা?

এই বিষয়ে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানা প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহন বন্ধ করা আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এটা পরিবহনমালিকদের সিদ্ধান্ত। তাঁর দাবি, ‘পরিবহন ধর্মঘট কেন করেছে, এটা পরিবহনের লোকেরা জানেন। আমরা সাংগঠনিক অবস্থা গিয়ারআপ (চাঙা) করার জন্য দুই দিন কিছু কর্মকাণ্ড করেছি।’

আজ শনিবার বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির নেতারা। নগরের ডাকবাংলো ও ফেরিঘাট মোড়ের মাঝামাঝি সোনালী ব্যাংক চত্বরে বেলা দুইটায় এই গণসমাবেশ হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

এ দিকে খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে বাধা দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি গতকাল সকালে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জনভীতি রোগে ভুগছে। জনগণকে ভয় পায় বলেই বিএনপির সমাবেশে বাধা সৃষ্টি করছে।

ক্ষমতাসীন দলের মহড়া, উৎকণ্ঠা

সকাল থেকে বাস ও নৌযান বন্ধ, ধরপাকড়, ছাত্রলীগ-যুবলীগের মোটরসাইকেল মহড়া, বিকেলে ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল—সব মিলিয়ে গতকাল দিনভর খুলনা নগর ছিল থমথমে। প্রয়োজন না হলে মানুষ ঘরের বাইরে বের হননি।

বেলা তিনটায় নগরের শিববাড়ী মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সমাবেশে বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে যোগ দেন নেতা-কর্মীরা। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল দলীয় কার্যালয়ের দিকে যায়। মিছিলটি বিএনপির সমাবেশস্থল অতিক্রম করার সময় রাস্তার দুই পাশে থাকা বিএনপির ব্যানার, ফেস্টুন ছিঁড়তে দেখা যায়। সন্ধ্যার পর মোড়ে মোড়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের দলবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। এতে শহরে আসা বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে খুলনায় আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি শহরের ৩ নম্বর ক্রস রোডের পশ্চিম বানিয়া খামার এলাকায় একটি বাসায় উঠেছেন। বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক ওই বাসায় যান। গয়েশ্বর চন্দ্র তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা পুলিশের লোক বলে জানান। পরে সেখান থেকে ১৯ জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে গণপরিবহন বন্ধ, অন্যদিকে রাস্তায় রাস্তায় মহড়ায় শহরে একটা ভুতুড়ে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। কর্মীরাও আতঙ্কে আছে। দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের চেয়ে খুলনায় সমাবেশ ঠেকানোর পদ্ধতি এক ধাপ এগিয়ে।

এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় বিএনপির শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে গতকাল ৬৮ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

এই বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, এটা পুলিশের রুটিন কাজ, সারা বছর চলে। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ এ রকম করছে, বিএনপির এই দোষারোপ ঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘এই শহরে এখন বিএনপির হাজার হাজার কর্মী আছেন। আমরা কতজনকে ধরছি?’

সড়কপথে মানুষের ভোগান্তি

গণসমাবেশের আগের দিন গতকাল খুলনায় শুরু হয়েছে দুই দিনের ‘পরিবহন ধর্মঘট’। এ কারণে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, নড়াইল, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা থেকে খুলনায় কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারেনি। সড়ক ও মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ সব অবৈধ যান চলাচল বন্ধের দাবিতে হঠাৎ এই ধর্মঘটের ডাক দেয় জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি। ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন।

বিএনপির অভিযোগ, তাদের গণসমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ঠেকাতে ‘ষড়যন্ত্র’ করে এ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।

ঢাকা-খুলনা সড়কপথে চলাচলকারী বাস ঢাকা থেকে যশোর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত চলছে। সাতক্ষীরামুখী যেসব বাস যশোর হয়ে চলে, সেগুলো চলছে। তবে যেগুলো খুলনা হয়ে চলে, সেগুলো বন্ধ রয়েছে। মূলত খুলনায় কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে ও খুলনা থেকে বিভিন্ন সড়কপথে গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে সমাজসেবা কার্যালয়ের ইউনিয়ন সমাজকর্মী নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা ব্যক্তিদের ভোগান্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। বাস বন্ধ থাকায় চাকরিপ্রার্থীরা ইজিবাইক ও ভ্যানে করে খুলনায় এসেছেন।

ডুমুরিয়ার চুকনগর থেকে খুলনার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। সমাজকর্মী নিয়োগ পরীক্ষা দিতে সেখান থেকে গতকাল সকাল ছয়টার দিকে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেন কমলেশ বৈরাগী। সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় খুলনা নগরীর জিরো পয়েন্ট এলাকায়। তিনি বলেন, ইজিবাইক ও ভ্যানে ভেঙে ভেঙে অনেক কষ্টে খুলনায় পৌঁছেছেন তিনি। ফিরবেন কীভাবে, সে দুশ্চিন্তায় আছেন।

যশোর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে কোনো বাস ও মাইক্রোবাস বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভাড়া দেওয়া হয়নি বলে জানান দলটির নেতারা। যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন, ‘যশোরের কোনো বাস বা মাইক্রোবাস আমাদের কাছে ভাড়া দিচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের অনেকে বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।’

গতকাল সকালে বাগেরহাট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালের সব কটি পরিবহনের কাউন্টার বন্ধ। বাগেরহাট থেকে খুলনাগামী বাস ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অভ্যন্তরীণ সড়কপথের কোনো বাস চলছে না। বাস টার্মিনালসহ আশপাশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের লাঠি হাতে টহল দিতে দেখা গেছে।

কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী বাস যশোর এসে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাত্রীরা অটোরিকশা বা নছিমনে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে গেছেন।

নদীপথেও চলাচল বন্ধ

বাস ধর্মঘটের পাশাপাশি গতকাল সকাল ১০টায় খুলনায় লঞ্চ ধর্মঘটও শুরু হয়। ১০ দফা দাবিতে হঠাৎ ৪৮ ঘণ্টার ওই ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন। ফলে খুলনা থেকে দক্ষিণ দিকে (দাকোপ, কয়রা ও সাতক্ষীরা) যাতায়াতের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চশ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকেরা। তিনি দাবি করেন, অনেক আগেই এই দাবিগুলো মেনে নেওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে (আলটিমেটাম) দেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে বিএনপির সমাবেশের সম্পর্ক নেই।

খুলনার বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই প্রত্যাশিত নয় উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সাধারণ সম্পাদক কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষ তার রাজনীতি করবে এবং স্বাধীনভাবে কথা বলবে, এটাই কাম্য। জনগণের মতামত, সমালোচনাকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেন, ‘খুলনার প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয়, বাধা দিয়ে মানুষের মধ্যে আরও উৎসাহ তৈরি করা হচ্ছে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা; নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ; প্রতিনিধি, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট]