অতীতে রাজনীতিতে বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতায় বেশি লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ

ক্ষমতা হস্তান্তরে গ্রহণযোগ্য পথ না থাকা এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতার কারণে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিচ্ছে বিদেশিরা। রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার প্রয়োজন বোঝাতে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যেতে বৃহৎ শক্তিগুলো চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তবে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর দেওয়া বার্তা না শুনে তাদের বরং শত্রু বানানো হচ্ছে। অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতা থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই।

আজ রোববার ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে বিদেশি শক্তির প্রভাব’ শীর্ষক ওয়েবিনারে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনারের আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।

ওয়েবিনারে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ এবং সংকট নিরসনে তাদের নেওয়া উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৯৬, ২০০৬ ও ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা বলে, বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতা থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের সংযুক্তিতে রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই আপত্তি করেনি বলেও মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তখনই হস্তক্ষেপ বলে, যখন বিষয়টি তাদের স্বার্থের অনুকূলে থাকে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনে বিদেশিদের প্রভাব বিস্তার ও কূটনৈতিক উদ্যোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে কয়েকটি কারণে। সাংবিধানিকভাবে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে। ক্ষমতা হস্তান্তরে গ্রহণযোগ্য পথ তৈরিতে ব্যর্থতা ও পারস্পরিক আস্থাহীনতা।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, এটি অকস্মাৎ হয়নি। গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র বারবার নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। ভিসা বিধিনিষেধ নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের অবস্থান অস্পষ্ট। একবার দলের নেতারা বলছেন, এটি শেখ হাসিনার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির সমার্থক। এ বিষয়ে তাঁরা চিন্তিত নন। আবার বলছেন, এটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সবচেয়ে বড় ঘটনা প্রতিবেশী দেশ ভারত ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিপদাপন্ন হবেন না। ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ এতটা গভীর যে অন্যান্য বিবেচনা এখানে গৌণ।

প্রণব মুখার্জি তাঁর আত্মজীবনীতে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা লিখেছেন বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ।

সমাপনী বক্তব্যে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটাধিকার একটি মানবাধিকার, এটি শুধু ক্ষমতার বদল নয়। এটি জনগণের লাল কার্ড দেখানোর সুযোগ। মানবাধিকার কারও অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার সবার আছে। বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, হস্তক্ষেপ নয়। এসব বার্তা না শুনে তাদের শত্রু বানানো হচ্ছে।

দেশে দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে। নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ ইসির কাছ থেকে চলে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। প্রশাসনে চরম দলীয়করণ হয়েছে। সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নেই। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে অসাংবিধানিকভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়েছে।

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন আরেক আলোচক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো শ্রীরাধা দত্ত। তিনি বলেন, এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে, সরকারি ও বিরোধী দল দুই মেরুতে অবস্থান করছে। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস নেই। রাজনৈতিক নেতারাই বাইরের দেশগুলোকে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে ভারত অনিরাপদ বোধ করে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় ভারত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভিসা বিধিনিষেধ ভারত সমর্থন করে না। তাঁর মতে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই ভারতবিদ্বেষ আছে। তরুণদের অনেকের ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিতে না পেরে আওয়ামী লীগের ওপর রাগ আছে, সেই রাগ ভারতের প্রতিও আছে। তাঁরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ যা–ই করুক, ভারত সামলে নেবে।

ওয়েবিনারে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ ঘাটতির কারণে বিদেশিদের কথা শুনতে হচ্ছে। কাঠামো শক্তিশালী হলে, পারস্পরিক আস্থা ও সহাবস্থান তৈরি করতে পারলে বিদেশিদের কথা শুনতে হতো না৷ বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্রচর্চা ও ন্যায়বিচারের মতো দায় আছে। এগুলোতে ঘাটতি থাকায় বিদেশি বন্ধুরা পরামর্শ দিচ্ছে। এটাকে হস্তক্ষেপ না বলে পারস্পরিক প্রত্যাশা বলা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দলকে পরামর্শ দিয়ে হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যেতে উৎসাহিত করতে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ তৈরি করতে চায়, যেন দলগুলো নিজেরা উপলব্ধি করে, আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য কাঠামো দাঁড়াবে, যার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন করা যাবে।

সাংবাদিক মনির হায়দার ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন।