তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ‘দলঘনিষ্ঠদের’ বিষয়ে বুঝতে চেয়েছে এনসিপি

বৈঠকের পর এনসিপির নেতাদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্য উপদেষ্টারা। বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

বিএনপি গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন থেকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ‘দলঘনিষ্ঠদের’ বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে বলেছিল। পরদিনই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এ দুটি বিষয় তুলেছেন।

গতকাল বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা’ বলতে কী চাইছে এবং ‘দলঘনিষ্ঠ’ উপদেষ্টা আখ্যা দিয়ে কাদের সরাতে চাইছে—গতকালের বৈঠকে এনসিপি নেতারা সেটা জানা-বোঝার চেষ্টা করেছেন।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে এনসিপির নেতাদের কাছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা চেয়েছে।

তবে এনসিপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ে তাদের ম্যান্ডেট। হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শটি দুরভিসন্ধিমূলক। নিজেদের এই মনোভাবের কথা এনসিপির নেতারা বৈঠকে তুলে ধরেন।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়
ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

এ কথা উল্লেখ করে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে তাঁরা বিচার, জুলাই সনদ ও নির্বাচনের রোডম্যাপও (পথনকশা) চেয়েছেন। বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের হুমকি, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার—এসব বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদে থাকা দলঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার যে দাবি বিএনপির দিক থেকে জানানো হয়েছে, সেখানে দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে নির্দেশ করা হয়েছে, এনসিপি নেতাদের অনেকের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, বিএনপি দুই ছাত্র উপদেষ্টা নয়; অন্য একজন উপদেষ্টার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছে।

গতকালের বৈঠকে অংশ নেওয়া এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার পুনর্গঠন করার প্রয়োজন হলে সেটা যেন ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে করা হয়, সেটি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছে এনসিপি। এ ছাড়া কাউকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী যেসব উপদেষ্টা সরকারে আছেন, তাঁদেরও যেন বাদ দেওয়া হয়, সে কথাও এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

গতকালের বৈঠকে এনসিপির নেতাদের মধ্যে দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও অংশ নেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ছিলেন।

আরও পড়ুন

জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আহ্বান

গতকালের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করার জন্য এনসিপির প্রতি আহ্বান জানান। এ বিষয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তারা সনদ স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

এ ছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে সম্পর্কেও কথা বলেন এনসিপি নেতারা। বৈঠকের পর যমুনার সামনে ব্রিফিংয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতি নন, আদেশ জারি করতে হবে প্রধান উপদেষ্টাকে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের যে সার্বভৌম ক্ষমতা, সেটার একমাত্র বৈধতা অধ্যাপক ইউনূসেরই আছে, সেটা রাষ্ট্রপতির নেই। সেটার আইনি এবং রাজনৈতিক কারণ আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছি।’

জুলাই সনদের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) নিয়েও নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বৈঠকে তুলে ধরেছে এনসিপি। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলেছি নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। সবাই যে বিষয়গুলোতে একমত হয়েছে, জুলাই সনদ যে বিষয়গুলোর ওপর রচিত হয়েছে, তার পুরোটাই গণভোটে যাবে এবং গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে পরবর্তী সংসদের একটা গাঠনিক ক্ষমতা থাকবে, যার ফলে তারা একটি সংস্কারকৃত নতুন সংবিধান তৈরি করবে। ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দেবে, সরকার সে অনুযায়ী কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটার ওপর নির্ভর করে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনা করব।’

আরও পড়ুন

ইসি পুনর্গঠনের দাবি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়
ছবি: মীর হোসেন

বৈঠকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে বলে জানান নাহিদ। তিনি বলেন, ইসির গঠনপ্রক্রিয়া ও নির্বাচন কমিশনের বর্তমান আচরণ এনসিপির নিরপেক্ষ বা স্বচ্ছ মনে হচ্ছে না। ইসি কোনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং কোনো কোনো দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশন এই মুহূর্তে পুনর্গঠন হওয়া প্রয়োজন।’

প্রশাসনে ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে

সংবাদ ব্রিফিংয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্র উপদেষ্টারা কোনো দলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, গণ–অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে রয়েছেন। ফলে অন্য উপদেষ্টারা যে রকম, ছাত্র উপদেষ্টারাও সে রকম। ছাত্র উপদেষ্টাদের যদি কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখা হয়, অন্য অনেক উপদেষ্টাদেরও বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সেই বিষয়গুলোও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সরকার যখন গঠিত হয়েছিল, বিভিন্ন দলের রেফারেন্সেই কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে। ফলে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নয়; অন্য যে উপদেষ্টারা রয়েছেন, তাঁদের নাম আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।’

জনপ্রশাসনে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ বদলি-পদায়ন নিয়েও বৈঠকে কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি ও শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত, তারা নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি-ডিসি ভাগ-বাঁটোয়ারা করছে। নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা সরকারকে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকেও সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে।’

এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে উল্লেখ করে নাহিদ আরও বলেন, সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে ফাংশন করে এবং উপদেষ্টা পরিষদে যাঁদের বিরুদ্ধে এই সংশ্লিষ্টতাগুলো রয়েছে, অদক্ষতা-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের, তাঁদের বিষয়ে যাতে প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেন।