সংঘাত এড়িয়ে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য

সংসদ সদস্যরা উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিজের জন্য ঝুঁকি মনে করছেন। ফলে তাঁরা ঘনিষ্ঠদের চেয়ারম্যান বানাতে মরিয়া।

এবারের উপজেলা নির্বাচন চার পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছেপ্রতীকী ছবি

দলীয়ভাবে চেষ্টা করেও উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের তৎপরতা ঠেকাতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অনেকটা হতাশ হয়েই হাল ছেড়ে দিয়েছেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা। তবে এখন সরকারি প্রশাসনের মাধ্যমে সংঘাত এড়ানো ও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা আছে আওয়ামী লীগের।

আজ বুধবার প্রথম পর্বের ভোটে আওয়ামী লীগের হিসাব অনুযায়ী, ৫০ জনের মতো মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন রয়েছেন। এর বাইরে প্রায় সব উপজেলাতেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের ‘ঘনিষ্ঠজন বা অনুগত’ নেতারা ভোট করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটে সংঘাত এড়ানোই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির।

এবারের উপজেলা নির্বাচন চার পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ প্রথম পর্বে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাউকে এবার দলীয় প্রতীক দেয়নি। ফলে প্রতিটি উপজেলাতেই দলের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। অনেক স্থানে ‘এমপির প্রার্থী বনাম অন্যান্য নেতা’—এ ধরনের পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে, যা ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দলের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা ভোট থেকে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সংসদ সদস্যদের স্বজনদের পরিধি স্ত্রী–সন্তানে বেঁধে দেওয়া, বর্তমানে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের নিষেধের আওতায় না আনা—এসব শিথিলতাও দেখানো হয়। কিন্তু লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি দল।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিজের জন্য ঝুঁকি মনে করছেন। ফলে তাঁরা নিজের স্বজন বা ঘনিষ্ঠদের চেয়ারম্যান বানাতে মরিয়া। এটাই শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চোখ থাকবে যেসব এলাকায়

প্রথম ধাপের ভোটে আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখ থাকবে নোয়াখালী, মাদারীপুর, বগুড়া ও পাবনাসহ কয়েকটি জেলায়। এসব স্থানে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের প্রার্থী হওয়ায় এরই মধ্যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণেও এসব স্থানে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের।

মাদারীপুর জেলার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে ঘিরে বিভক্ত। এবার উপজেলা ভোট নিয়ে পুরোনো দ্বন্দ্ব আরও জোরালো হয়েছে। শাজাহান খান নিজের ছেলে আসিবুর রহমান খানকে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করিয়েছেন। বাহাউদ্দিন নাছিম নেমেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান খানকে নিয়ে। ফলে ভোটের আগেই উত্তাপ ছড়িয়েছে।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদে টানা তিনবারের চেয়ারম্যান হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী। কিন্তু এবার স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী তাঁর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরীকে প্রার্থী করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভেদ তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, উপজেলার এই ভোটকে কেন্দ্র করে শাজাহান খান ও একরামুল করিম চৌধুরীর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়েছেন দলটির নেতৃত্ব। তাঁদের বিষয়টিই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের ভোটে না থাকার নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ।

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আলী আজগারের ভাই আলী মুনছুর ভোট করছেন। সদরে সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের ভাতিজা নঈম হাসান জোয়ার্দ্দারও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। জেলার অন্য প্রার্থীরা সংসদ সদস্যদের প্রভাব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বারবার চেষ্টা করেও সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে শাখাওয়াত হোসেনকে বসানো যায়নি। এর পাশের সোনাতলা উপজেলাতেও ওই সংসদ সদস্যের ভাই মিহাদুজ্জামান প্রার্থী হয়েছেন।

‘সুষ্ঠু ভোটের চেষ্টা’

আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে, সাংগঠনিকভাবে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের প্রভাব ঠেকানো সম্ভব না হওয়ায় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজে এবং সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারা নিজেদের মতো করে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

গত রোববার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ সচিবালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও সরকারি সুবিধাভোগী ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের প্রচারে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিশেষ নির্দেশনা জারির অনুরোধ জানানো হয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের প্রভাব ঠেকাতে না পারলে সংঘাত এড়ানো কঠিন। কারণ, প্রায় সব জায়গায় সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠজনদের বাইরে যারা ভোট করছেন, তাদেরও প্রায় সবাই দলের পদধারী নেতা। ফলে ভোটের দিন প্রভাব বিস্তার করতে গেলে কেউ কাউকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। এ জন্য সংঘাত এড়িয়ে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোই এখন আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, যে যা-ই বলুক না কেন, কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। সেভাবেই প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। নির্বাচন কমিশনও কঠোর অবস্থানে।