আহ্বায়ক কমিটিতে চলছে বিএনপি, আওয়ামী লীগ–জাপায় নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে রয়েছে সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা। আন্দোলন নিয়েই ব্যস্ত বিএনপি।

ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রচলিত কথা হচ্ছে, ‘মেয়র গ্রুপ’ আর ‘শান্ত গ্রুপ’। দুই পক্ষের বিরোধে একসময় দলীয় কর্মসূচি পালন করা হতো পৃথকভাবে। এখন পরস্পর হাত ধরে রাজপথে মিছিল করেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র মো. ইকরামুল হক এবং সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান। প্রকাশ্যে বিরোধ মিটলেও দুই পক্ষের পৃথক অবস্থান আগের মতোই রয়ে গেছে।

জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি ‘কোন্দলমুক্ত’ই ছিল। সম্প্রতি দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিতর্কিতদের কমিটিতে স্থান দেওয়ার অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করেছেন বঞ্চিত নেতারা।

এদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ দেখা গেলেও সংগঠন বেহাল। ময়মনসিংহ উত্তর ও দক্ষিণ জেলা এবং মহানগর বিএনপি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সুর শোনা যায়। আন্দোলনের কারণে দল গোছাতে দেরি হচ্ছে বলে দাবি নেতাদের। অন্যদিকে কেন্দ্রের বিরোধের ছায়া রয়েছে জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। দলীয় কর্মসূচি পালিত হয় পৃথকভাবে। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতাও আছে দলের নেতাদের মধ্যে।

নগর আওয়ামী লীগে ‘প্রতিযোগিতা’

ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি হয় ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর। তবে এর আগে থেকেই মেয়র ইকরামুল ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমানের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। সে বিরোধ ছিল জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির অংশ। মহানগরের প্রথম কমিটিতে ইকরামুল হক সহসভাপতি ও মতিউর রহমানের ছেলে মোহিত উর রহমান সাধারণ সম্পাদক হন। তখনো দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি দুই পক্ষ পৃথকভাবে পালন করত। দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নানা বিষয়ে বিরোধ লেগেই ছিল।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো হওয়া মহানগরের কমিটিতে ইকরামুল সভাপতি ও মোহিত সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর প্রকাশ্যে বিরোধিতা মিটে যায়। তবে নেতা-কর্মীদের নিয়ে দুই নেতার পৃথক বলয় আগের মতোই আছে। যদিও দুই নেতা বিরোধের বিষয়টি মানতে নারাজ।

মোহিত উর রহমান আগামী নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি বলেন, ‘আমরা দুজন মিলে একসঙ্গে সাংগঠনিক কাজ করে যাচ্ছি। তাহলে কেন বিরোধ বলা হবে। প্রকৃত অর্থে আমরা দুজন একই বয়সের। সেখানে প্রতিযোগিতা রয়েছে।’

মেয়র মো. ইকরামুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিন্তু দলের সাংগঠনিক বিষয়ে কোনো বিরোধিতা নেই। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন আন্দোলন মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে মহানগর ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।

নিরুত্তাপ জেলা আ.লীগে কমিটি নিয়ে উত্তাপ

গত ৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এর প্রায় ১০ মাস পর গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয় ৭৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। রয়েছে ২৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ। প্রায় নিরুত্তাপ জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্প্রতি কিছুটা উত্তাপ ছড়িয়ে এ কমিটির ঘোষণা।

‘পদবঞ্চিত’ জেলা যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের সাবেক নেতারা পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পাওয়া বিতর্কিতদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এ তালিকায় থাকা ১৬ জনকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি নন। তিনি শুধু বলেন, সব বিষয় কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করা হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে আওয়ামী লীগের নয়জন সংসদ সদস্যকে। জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে এই ৯ জনসহ কমিটির অন্তত ২৫ জন আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। সভাপতি এহতেশামুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেনও তাঁদের মধ্যে আছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সরকারের উন্নয়ন প্রচারের মাধ্যমে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন।

জেলা আওয়ামী লীগে বড় ধরনের কোনো কোন্দল নেই। তবে ধোবাউড়া ও মুক্তাগাছা উপজেলায় কোন্দল রয়েছে। ধোবাউড়ায় এই কোন্দলের এক পক্ষে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস। অন্য পক্ষে নেতৃত্ব দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিম।

সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং সরাসরি এই বিরোধের মধ্যে নেই। মুক্তাগাছায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সরাসরি বিরোধিতা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই আকন্দ। সম্প্রতি যুবলীগ কর্মী আসাদ হত্যার ঘটনায় এ বিরোধ আরও বেড়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় একটি দল। ছোটখাটো মতবিরোধ থাকতেই পারে। তবে কোনো কোন্দল নেই। একই আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর গণসংযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গণসংযোগকারীরা কেউ সরাসরি নিজের প্রার্থিতার কথা বলছেন না। তাঁরা আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন প্রচার করছেন।

আন্দোলনে নজর বেশি বিএনপির

ময়মনসিংহে তিনটি ইউনিটের অধীনে বিএনপির রাজনীতি পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে জেলা দক্ষিণ, জেলা উত্তর ও মহানগর বিএনপি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলো এখন এই তিন ইউনিট একসঙ্গে পালন করছে। যদিও তিনটি ইউনিটই চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। মহানগরের আহ্বায়ক এ কে এম শফিকুল ইসলাম, উত্তর জেলার আহ্বায়ক এনায়েতুল্লাহ কাজাম ও দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে মহানগর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটির বয়স প্রায় চার বছর। উত্তরের আহ্বায়ক কমিটি চলছে এক বছরের বেশি সময় ধরেই।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আহ্বায়ক কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ না হলেও ইতিমধ্যে এ তিন ইউনিটের অধীনে থাকা উপজেলা ও ওয়ার্ড শাখাগুলোয় কর্মী সম্মেলন হয়েছে। কোথাও কোথাও কমিটি হলেও অনেক কমিটি এখনো ঝুলে আছে। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে। তবে এমন সাংগঠনিক অবস্থার মধ্যে এক বছর ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশ গতি এসেছে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি চোখে পড়ে।

ময়মনসিংহ মহানগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। উত্তরের আহ্বায়ক কমিটি হয় ২০২২ সালের জুনে। মহানগরের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আবু ওয়াহাব আকন্দ বলেন, মহানগরের ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। মহানগর খুব ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। মিথ্যা মামলা ও পুলিশের হয়রানিকে উপেক্ষা করেও আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। আন্দোলনে ব্যস্ত থাকার কারণে এখনো সব কটি ওয়ার্ড কমিটি করা সম্ভব হয়নি।

উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে চলমান থাকার কারণেই কমিটি হতে কিছুটা দেরি হচ্ছে।

সক্রিয় জাপার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

ময়মনসিংহে ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির (জাপা) বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের কারণে ময়মনসিংহে দলের শক্ত অবস্থান রয়েছে বলে মনে করেন নেতা-কর্মীরা। রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।

এ ছাড়া ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনেও টানা দুই মেয়াদে দলের সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন ফখরুল ইমাম। যদিও দুটি আসনেই মহাজোটের শরিক আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। ঈশ্বরগঞ্জ আসনে ২০১৮ সালে জাপার প্রার্থী না দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়ার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

২০১৪ সালে ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনটিও জাপার ছিল। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা), ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর), ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) ও ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে জাপার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সক্রিয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রের মতো ময়মনসিংহেও জাপার রাজনীতিতে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরপন্থীদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলো এ দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা পৃথকভাবে পালন করে আসছেন।

অবশ্য জাপার ময়মনসিংহ জেলার সদস্যসচিব ও ময়মনসিংহ-৩ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের আগে দলের বিরোধ মিটে যাবে বলে আশা রাখছি।’