বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কৌশলের অনন্য নজির

একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার চাপ, অন্যদিকে নানা আশঙ্কা ও ভয়—এসব বিষয় মাথায় রেখেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক কৌশল ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন
ফাইল ছবি

ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণ দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী দেবেন, সে জন্য ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা।

তখন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে চাপ তৈরি করেছিল ছাত্রনেতাদের একটি অংশ। তবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন পাকিস্তানি শাসকেরা—এই আশঙ্কাও ছিল। আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ৭ মার্চের লাখ লাখ মানুষের জনসভাতেই আক্রমণ করতে পারে বা ক্র্যাকডাউনে যেতে পারে—এমন ভয়ও ছিল।

একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার চাপ, অন্যদিকে নানা আশঙ্কা ও ভয়—এসব বিষয় মাথায় রেখেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক কৌশল ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। সেই রাজনৈতিক কৌশল কী ছিল, তা নিয়ে এখনো চলছে নানা বিশ্লেষণ।

রাজনৈতিক কৌশল কী ছিল

গবেষক ও বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ পাননি পাকিস্তানি শাসকেরা। এটিকেই বিশ্লেষকেরা সে সময়ের জন্য দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন আফসান চৌধুরী। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে বাঙালি জাতি যেকোনো পরিস্থিতির জন্য যাতে প্রস্তুত থাকে, শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সে অবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল।

যদিও ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ওড়ানো হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরদিনই ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র–জনসভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে পাঠ করা হয়েছিল স্বাধীনতার ইশতেহার। এই ইশতেহারেই জাতীয় সংগীত কী হবে, সেটি যুক্ত করা হয়েছিল।

আফসান চৌধুরীর বক্তব্য হচ্ছে, আন্দোলন একটা পর্যায়ে এলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সেভাবে প্রস্তুতি ছিল না। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সশস্ত্র যুদ্ধসহ সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। তিনি আরও বলেছেন, লম্বা সময় যুদ্ধের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীও প্রস্তুত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় যেসব তথ্য পেয়েছেন আফসান চৌধুরী, তার ভিত্তিতে তিনি বলছেন, ক্র্যাকডাউনে গিয়ে দু-তিন দিন, সর্বোচ্চ সাত দিন শুধু ঢাকায় শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের প্রস্তুতি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। কিন্তু ৭১–এর ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর সারা দেশে মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছিল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছিল। এটি ৭ মার্চের ভাষণের ফসল বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী।

গবেষক আফসান চৌধুরী প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে আরও বলেছেন, যদিও ৭ মার্চের ভাষণের পর শেখ মুজিব পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। কিন্তু তাঁর ওই ভাষণ পাকিস্তানি শাসকদেরও মানসিক চাপে ফেলেছিল।

৭ মার্চের ভাষণের দুটি দিক

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি সেদিন রেসকোর্স ময়দানের (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সেই ভাষণের মঞ্চে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রধান দুটি দিক রয়েছে, যা বিশ্লেষণ করলে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) রাজনৈতিক কৌশল স্পষ্ট বোঝা যায়।

তোফায়েল আহমেদ উল্লেখ করেন, ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তানি শাসকদের চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এসব শর্তের মধ্যে ছিল প্রথমত, সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয়টি ছিল, সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ধারাবাহিক আন্দোলনে গুলি করে হত্যার ঘটনাগুলোর তদন্ত করতে হবে। আর চতুর্থ শর্ত ছিল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, এসব শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে ভাঙার দায় নেননি। তাঁকে কেউ যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে, এমন সুযোগ রাখেননি তিনি। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে মানুষকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—এই উক্তিগুলোর মাধ্যমে এল স্বাধীনতার বার্তা। ফলে যুদ্ধের প্রস্তুতি ৭ মার্চের ভাষণ থেকেই চূড়ান্তভাবে এসেছে বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।

ভাষণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যেভাবে

সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে চাপ যেমন ছিল, একই সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রাখার কৌশল তখন নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের ভাষণের আগের কয়েক দিনে ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি।

৬ মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বিষয়টি উল্লেখ করে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘৭ মার্চ ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় বঙ্গবন্ধুকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেছিলেন, “তুমি যা বিশ্বাস করো, তা–ই বলবে।” ৭ মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা এবং বিশ্বাস থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিল না।’

৭ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা এবং হাতাকাটা কালো কোট পরে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি এবং আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকসহ তরুণ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন বেলা দুইটার দিকে। আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্ন পথে জনসভাস্থলে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেই মঞ্চে সেদিন বঙ্গবন্ধু একাই ভাষণ দিয়েছিলেন।

তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, প্রায় ১৮ মিনিটের সেই ভাষণে মানুষের প্রত্যাশা ও পরিস্থিতি—সবদিকই উঠে এসেছিল।