গুমের মামলায় শুধু সেনা কর্মকর্তাদের আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন তাঁদের আইনজীবীর
র্যাবে পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা কাজ করলেও গুমের মামলায় শুধু সেনা কর্মকর্তাদের আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী তাবারক হোসেন। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাত করেছেন বলে তাঁর অভিযোগ।
আওয়ামী লীগ আমলে র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুমের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় আজ রোববার শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে তাবারক হোসেন সাংবাদিকদের কাছে এই বক্তব্য দেন, যা শুনানিতে তুলে ধরেছেন বলে জানান তিনি।
গুমের এই মামলার ১৭ আসামির মধ্যে যে ১০ জন গ্রেপ্তার আছেন, তাঁরা সবাই সেনা কর্মকর্তা। র্যাবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) এবং ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) শাখার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তারা। এই ১০ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ৭ জনের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাবারক হোসেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেছেন, এ মামলায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘হ্যান্ডপিক’ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা এখানে বায়াসড (পক্ষপাতদুষ্ট) ছিলেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, র্যাবের এডিজি (অতিরিক্ত মহাপরিচালক–অপারেশন্স) বিভিন্ন সময়ে বিদেশে গিয়েছেন। তখন বিভিন্ন সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পুলিশের একজন ডিআইজি সেই এডিজির দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু সেসব পুলিশ কর্মকর্তার একজনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়নি। তাহলে কি সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে না যে শুধু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল?
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের বহু অভিযোগ ওঠে। গত বছর অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। র্যাবের টিএফআই সেলে গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটিতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামি করা হয় ১৭ জনকে।
তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার ১০ জন সেনা কর্মকর্তা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, মো. কামরুল হাসান, মো. মাহাবুব আলম এবং কে এম আজাদ; কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে); লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম সুমন ও মো. সারওয়ার বিন কাশেম। আজ তাঁদের সবাইকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সেনানিবাসের অস্থায়ী কারাগার থেকে আদালতে নেওয়া হয়।
আইনজীবী তাবারক হোসেন বলেন, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের কাজ বুঝতে হবে। র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন। প্রতিটি ব্যাটালিয়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তাদের কাজের সঙ্গে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা এমন কথা বলেছেন জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, তিনি গুম কমিশনের একটি কথাও ট্রাইব্যুনালের নজরে এনেছেন। গুম কমিশনের কাজ পুলিশিং করা নয়। গুম কমিশনের কেউ যদি নিয়মনীতিবহির্ভূতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন, ট্রাইব্যুনালকে সেই জিনিসটার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ গণমাধ্যমে যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করেন, তা নিয়েও আদালতে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী তাবারক হোসেন। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন গণমাধ্যমে বলে ‘পেট চিরে নাড়িভুঁড়ি’ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের কথা ট্রমা তৈরি করে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে।
এ মামলায় প্রসিকিউশন ১ হাজার ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি নথিপত্র দিয়েছে জানিয়ে আইনজীবী তাবারক বলেন, প্রসিকিউশন এত ডকুমেন্টস দিয়েছে। সেসব দেখে তাঁর ডিফেন্স (আত্মপক্ষ) প্রস্তুতি নিতে হবে। সে জন্য তিনি তিন মাস সময় চেয়েছেন ট্রাইব্যুনালের কাছে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ আজ মামলাটির শুনানি হয়। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলার ১৭ আসামির অব্যাহতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। এরপর আদালত এই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হবে কি না, সে বিষয়ে ২১ ডিসেম্বর আদেশ দেওয়ার দিন ধার্য করেন।
গুমের ঘটনায় দুটি মামলার বিচার হচ্ছে ট্রাইব্যুনালে। অন্যটিতে আসামি ১৩ জন। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) গুম করে রাখার ওই মামলার আসামিদের মধ্যে ১০ জন পলাতক। গ্রেপ্তার আছেন তিন সেনা কর্মকর্তা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক তিন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।