বিএনপি ছেড়ে এনসিপির প্রার্থী হয়ে আলোচনায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী মনজুর

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সিরাজগঞ্জের ছয়টি সংসদীয় আসনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী তৎপরতা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর সাধারণ মানুষের মধ্যেও চলছে নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। কোনো আসনে আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার–প্রচারণা, কোথাও দলীয় কোন্দল। কোথাও আবার আলোচনা চলছে নেতাদের দলবদল নিয়ে।

জেলার ছয়টি আসনেই বিভিন্ন দলের মনোনীত প্রার্থীরা মাঠে নামায় দিন দিন নির্বাচনী উত্তাপ বাড়ছে। বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে দুটি আসনে কিছুটা দলীয় অসন্তোষ দেখা গেছে। সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে দলবদল করে এনসিপির প্রার্থী হয়ে আলোচনায় আছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মনজুর কাদের। তবে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে প্রচারণার জন্য মাঠে নেমেছেন। দলীয় প্রার্থীদের নিয়ে প্রতিটি আসনে মাঠে নেমেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরাও। দল দুটির প্রার্থীরা উঠান বৈঠক, মিছিল, পথসভা ও গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রাম থেকে শহরের সব জায়গায় ঝোলানো হয়েছে পোস্টার ও ব্যানার।

নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন পর্যন্ত জেলার চারটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সম্ভাব্য প্রার্থীরাও বিভিন্ন আসনে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে কারা সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন স্থানীয় ভোটাররা।

সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর ও সদরের একাংশ)

প্রথম পর্যায়ে মনোনয়ন ঘোষণার সময় বিএনপি আসনটি ফাঁকা রেখেছিল। দ্বিতীয় ধাপে ৪ ডিসেম্বর কাজীপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সেলিম রেজাকে প্রার্থী করে দলটি। এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্য কণ্ঠশিল্পী রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজমুল হাসান তালুকদার। মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় বিএনপির মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ রয়েছে বলে জানিয়েছেন নেতা–কর্মীরা।

তবে বিএনপির প্রার্থী সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপি এই আসনে তৃণমূল নেতা–কর্মীদের মূল্যায়ন করে তাঁকে মনোনীত করেছেন। তিনি সব দ্বন্দ্ব–বিদ্বেষ মিটিয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আসনটি দলকে উপহার দিতে চান।

এ আসনে জামায়াতের জেলা আমির শাহিনুর আলম দলীয় প্রার্থী। তিনি মনোনয়ন নিশ্চিতের পর থেকেই সভা-সমাবেশ শুরু করেন। আসনটিতে ইসলামী আন্দোলনের মনোনয়ন পেয়েছেন আবু জাফর। সিপিবির আবদুল বাকী ও বাসদের আবু সামা সরকারও প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জ-২ (সদর ও কামারখন্দ)

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জ–২ আসনে দলের প্রার্থী হয়েছেন। জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের জেলা সেক্রেটারি মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। ইতিমধ্যে কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে মাঠে চষে বেড়াতে শুরু করেছেন বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা।

বিএনপির প্রার্থী ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর এবার দেশের জনগণ অনেক আনন্দের সঙ্গে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আমরা নির্বাচিত হলে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কী কী কাজ করব, সেসব বিষয়ে প্রস্তাবনাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি।’

জামায়াতের প্রার্থী মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাঠে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাচ্ছি। তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে মিলিত হচ্ছি। এতে করে মানুষের ভালোবাসায় আমি চরমভাবে আশাবাদী।’

ইসলামী আন্দোলন এখানে প্রার্থী করেছে মো. মহিব্বুল্লাহকে। এ ছাড়া সিপিবি থেকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন রেজা ও বাসদের আবদুল্লাহ আল মামুন প্রার্থী হতে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ ও তাড়াশ)

জেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আয়নুল হক এখানে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। আসনটিতে ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন বিএনপি নেতা আবদুল মান্নান তালুকদার। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে রাহিদ মান্নান লেলিন এবার বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি মনোনয়ন না পাওয়ায় দলের একটি অংশ নির্বাচনী মাঠে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

আয়নুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমি আমার দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছি। মানুষ দীর্ঘদিন তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এবার যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে ঈদের দিনের মতো আনন্দের সঙ্গে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুল ভোটে আমাকে জয়ী করবেন। এমনটি আমার বিশ্বাস।’

এখানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মোহাম্মদ আবদুস সামাদকে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। এনসিপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক দিলশানা পারুল। আসনটিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী গাজী আইনুল হক। এ ছাড়া সিপিবির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফা নুরুল আমিন ও বাসদের পলাশ কুমার ঘোষও মাঠে আছেন।

সিরাজগঞ্জ-৪ (উল্লাপাড়া)

এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম আকবর আলী। তবে এ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর উল্লাপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আজাদ হোসেনের সমর্থকেরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে মশালমিছিল ও মানববন্ধন করেন।

আজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১৬ বছরে এম আকবর আলীকে মাঠে দেখা যায়নি। যে কারণে তাঁর নামে কোনো মামলাও হয়নি। ওই সময়ে আমি মাঠে থেকে বিএনপির রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছি। ৭০টি মামলার আসামি হয়েছি। ২৬ বার জেলহাজতে গিয়েছি। এখন দল কেন আমাকে কেন অবমূল্যায়ন করবে?’

এম আকবর আলী বলেন, ‘তৃণমূলের মানুষের প্রত্যাশাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতেই আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জনগণ আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে ইনশা আল্লাহ।’

এখানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, জনগণ রফিকুল ইসলাম খানকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তিনি যেখানেই যাচ্ছেন, লোকজন তাঁকে ঘিরে ধরছেন।

এই আসনে এনসিপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজ এলাকার (উল্লাপাড়া) মানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি।’

বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দলটির উপজেলা সভাপতি আবদুল হাকিম প্রার্থী হচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি ও চৌহালী)

বিএনপি ছেড়ে এনসিপির প্রার্থী হয়ে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আলোচনায় এসেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মনজুর কাদের। তিনি আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে বিএনপি দলের রাজশাহী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আমীরুল ইসলাম খান আলীমকে প্রার্থী করেছে।

মনজুর কাদেরের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি বিএনপির জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ ও দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন মনজুর কাদের। এরপর এনসিপিতে যোগদান করে এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।

এনসিপির মনোনয়ন পাওয়ার পর মনজুর কাদের ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা ও নতুন রাজনীতির ধারণায় বিশ্বাস রেখে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে নিজেকে সম্পৃক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে আমি জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) যোগদান করেছি এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়ন পেয়েছি।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এনসিপি-ই পারে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে সামনে এনে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং দেশের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।’

বিএনপির প্রার্থী আমীরুল ইসলাম খান আলীম নেতা–কর্মীদের নিয়ে এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা করছেন। তিনি বলেন, ‘এলাকার মানুষের কাছে আমি যেটুকু প্রত্যাশা করেছিলাম, ইনশা আল্লাহ তার চাইতেও অনেক গুণ বেশি সাড়া পাচ্ছি।’

আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী আলী আলম। তিনি জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে মাঠপর্যায়ে প্রচারণাসহ নির্বাচন প্রস্তুতি বলতে গেলে শতভাগ শেষ করে ফেলেছি। এখন জনগণ শুধু ভোটের জন্য অপেক্ষায় আছেন। ইনশা আল্লাহ এই আসনে আমরা চরমভাবে আশাবাদী।’

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী শেখ মুহাম্মদ নুরুন নবী এবং গণ অধিকার পরিষদের সম্ভাব্য প্রার্থী সোহরাওয়ার্দী হোসেনও প্রচারণায় রয়েছেন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মতিউর রহমান প্রার্থী হতে পারেন।

সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর)

এ আসনে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা এম এ মুহিতকে প্রার্থী করেছে দলটি। তিনি সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী প্রয়াত এম এ মতিনের ছেলে। এম এ মুহিত বলেন, ‘আমরা সব বিদ্বেষ ভুলে এক হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তৃণমূলের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে।’

আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী মিজানুর রহমান। তিনি শাহজাদপুর উপজেলা জামায়াতের আমির। এনসিপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব এস এম সাইফ মুস্তাফিজ। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের জেলা কমিটির উপদেষ্টা মেসবাহ উদ্দিন ও বাসদ নেতা আনোয়ার হোসেন প্রার্থী হচ্ছেন।