এবারও ‘বয়স্ক’ নেতাদের পুনর্বাসন

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের ২৫ জনের বয়স ৭০ বছরের বেশি। স্থানীয়ভাবে তাঁরা ‘বঞ্চিত’ নেতা হিসেবে পরিচিত।

দেশের ৬০টি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের গড় বয়স ৬৮ বছরের বেশি। এর মধ্যে ৮০ বছরের বেশি বয়সী রয়েছেন ৫ জন। সত্তরোর্ধ্ব রয়েছেন ২০ জন। স্থানীয়ভাবে তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘বঞ্চিত’ নেতা হিসেবে পরিচিত। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন সময় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি।

গত শনিবার রাতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় ৬০টি জেলা পরিষদে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। সাতক্ষীরার প্রার্থিতা ঘোষণা করা হয়নি। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য ও স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বয়স এবং দলে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) বাদে বাকি ৬১ জেলা পরিষদের নির্বাচন আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পরিষদে সাধারণ ভোটাররা ভোট দেন না। উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এখানে ভোটার।

দেশের প্রথম নির্বাচিত জেলা পরিষদগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ১৭ এপ্রিল ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল বিলুপ্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী, প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না।

এবার ৬১টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রায় ৫০০ প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। সংসদ সদস্য হতে পারেননি কিংবা ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম—এমন নেতাদের এ পদে ঝোঁক বেশি। এ জন্য এ পদে প্রবীণ নেতাদেরই বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়। ৩১টি জেলায় এবার নতুন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ, ২৯টি জেলাতেই আগের চেয়ারম্যানরা মনোনয়ন পেয়েছেন। জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মেয়াদ পাঁচ বছর।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তর জেলা পরিষদকে বয়স্ক ও বঞ্চিত নেতাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ ১২ ধরনের বাধ্যতামূলক কাজ করে জেলা পরিষদ। এ ছাড়া সাতটি ক্ষেত্রে ৬৮ ধরনের ঐচ্ছিক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জেলা পরিষদগুলোর বরাদ্দও কম নয়। বয়স্ক চেয়ারম্যানদের পক্ষে কাজের চাপ সামলানো কঠিন।

বয়স্কদেরই প্রাধান্য

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ৮৮ বছর বয়সী মকবুল হোসেন। দলের মনোনয়ন পাওয়া সবচেয়ে বেশি বয়সী তিনি। ২০১১ সাল থেকে জেলা পরিষদের প্রশাসক ও চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন। আর দেড় দশক ধরে তিনি বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে এবার জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নবীন-প্রবীণ ১৩ নেতা মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেন। তবে মকবুল হোসেনকেই যোগ্য প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

মনোনয়নবঞ্চিত একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মকবুল সাহেব বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারেন না। অফিসের চেয়ারে বসে দাপ্তরিক ও রুটিন কাজের বাইরে দৌড়ঝাঁপ করার মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই। জেলা পরিষদের অনেক উদ্যোগ মাঝপথে আটকে আছে।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরপরই মনোনয়নবঞ্চিত বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দ ফেসবুক লাইভে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকার ঘোষণা দেন। গতকাল রোববার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র গ্রহণও করেছেন।

আবদুল মান্নান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মকবুল হোসেন বয়োজ্যেষ্ঠ, মুরব্বি ও সজ্জন। সবই ঠিক আছে, কিন্তু জেলা পরিষদ কি আওয়ামী লীগের “বয়স্ক” নেতা পুনর্বাসনকেন্দ্র? ৮৮ বছর বয়সী একজন মানুষের পক্ষে এ পদে কি দায়িত্ব পালন সম্ভব? তাঁর চেয়ে কম বয়সী ও যোগ্য কোনো নেতা কি বগুড়া আওয়ামী লীগে ছিল না?’

মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. মহিউদ্দিনের বয়স এখন ৮১ বছর। ২০১১ সাল থেকে তিনি জেলা পরিষদের দায়িত্বে আছেন। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি তিনি। গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিতেই তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে জেলা পরিষদের দায়িত্ব দিয়েছে। তবে বয়সের কারণে প্রায়ই অসুস্থ থাকেন তিনি।

নাটোর জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক সাজেদুর রহমান খান ২০১১ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন। তাঁর বয়স ৮৩ বছর। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হতে চেয়েছেন। কিন্তু একবারও প্রার্থী হতে পারেননি। বর্তমানে সাজেদুর রহমানের একা চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তাঁর সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজন সহকারী থাকেন।

আশি ঊর্ধ্ব মনোনয়নপ্রাপ্ত আরও দুজন হলেন জয়পুরহাটের খাজা সামছুল আলম (৮৫) এবং নওগাঁর এ কে এম ফজলে রাব্বি (৮৪)।

এবার জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৫ জনের বয়স ৭০ বছরের বেশি। ৬০ বছরের কম বয়সী আছেন আটজন। বাকি ২৭ জনের বয়স ৬০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। সবচেয়ে কম বয়সী সিলেটের নাসির উদ্দিন খান (৫৩)। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলের তৃণমূলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন দল করেও যাঁরা সংসদ সদস্য হতে পারেননি, সেটাও বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১১ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দেন। বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশের ওপর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের মনোনীত, সমর্থিত কিংবা দলটির নেতা-কর্মী বলে জানা গেছে। এবার জেলা পরিষদ নির্বাচনেও অনেক জেলায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।

বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার

খাজা সামছুল আলম ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-১ (সদর-পাঁচবিবি) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হন। এরপরের দুটি জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। এবার ৮৫ বছর বয়সে তাঁকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দল মনোনীত করেছে।

রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম শফিকুল মোরশেদ। তিনি পাংশা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। শফিকুল পাংশা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বাবা পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। এবার শফিকুল নৌকা প্রতীক নিয়ে জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা চন্দন শীল। তিনি ২০০১ সালের ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলার ঘটনায় দুই পা হারান। চন্দন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

চুয়াডাঙ্গায় মনোনয়ন পেয়েছেন দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক মাহফুজুর রহমান। তিনি ২০১৬ সালেও জেলা পরিষদে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

মুশফিক হুসেন চৌধুরী ২০১১ সাল থেকে হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের দায়িত্বে আছেন। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিন দশক। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। একবারও দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে ২০১০ সালে এ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

একমাত্র নারী প্রার্থী ও চিফ হুইপের চাচাতো ভাই

পিরোজপুরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সালমা রহমান। দলের মনোনয়ন পাওয়া একমাত্র নারী প্রার্থী তিনি। সালমা জাতীয় মহিলা পরিষদের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি পিরোজপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের স্ত্রী।

মাদারীপুরে দলের মনোনয়ন পাওয়া মুনীর চৌধুরী জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। তিনি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য নূর-ই আলম চৌধুরীর চাচাতো ভাই।

জেলা পরিষদকে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদকে আওয়ামী লীগের নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র করে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, সরাসরি নির্বাচনের বিধান না রেখে জেলা পরিষদকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে, সেটি সঠিক প্রক্রিয়া নয়। জেলা পর্যায়ের সরকারের বিভাগগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই জেলা পরিষদের। জেলা পরিষদকে অকার্যকর ও বিকলাঙ্গ করে রাখা হয়েছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]