সাক্ষাৎকার: মাওলানা গাজী আতাউর রহমান

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর–পরবর্তী রাজনীতি, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের জোটবদ্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

প্রথম আলো:

অবশেষে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হলো। এখন সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এটিকে ঘিরে নতুন কোনো সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখেন কি?

গাজী আতাউর রহমান: জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির বিষয়টার সমাধান হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে যে সনদ বাস্তবায়নে আগে একটা আদেশ হবে, এরপর সনদের ওপর একটা গণভোট হবে। ফলে এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত তো হয়েছে। এনসিপিও এর সঙ্গে একমত।

গণভোটটা কখন হবে, তা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। বিএনপিসহ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট চায়। আর এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল গণভোট আগে করার কথা বলছে। তবে পরবর্তী সময়ে আমরা এটা কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছি, কমিশনই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে। ফলে এটা নিয়ে একটা বড় সংকট হবে, সেটা আমরা মনে করছি না।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্রতারণা বলেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। অভিন্ন পাঁচ দফা দাবিতে এই আন্দোলনে জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের দলও রয়েছে। নাহিদের এমন সমালোচনাকে কীভাবে দেখেন?

নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না বিভিন্ন কারণে। একেক সময় রং একেক রকম হচ্ছে।

গাজী আতাউর রহমান: নাহিদ ইসলাম এমন কথা কেন বললেন, সেটার ব্যাখ্যা হওয়া উচিত। আশা করি, তিনি এটার ব্যাখ্যা দেবেন। জামায়াত ইতিমধ্যে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে। আমরা যদি বলি, শাপলা প্রতীক নিয়ে এনসিপির বাড়াবাড়ি হলো তাদের নির্বাচনে না যাওয়ার একটা বাহানা—তারা কি এটা ভালোভাবে নেবে?
প্রত্যেকেরই আলাদা চিন্তা ও রাজনীতি আছে। কিন্তু আমাদের দাবির বিষয় সম্পর্কে ‘প্রতারণা’ বা এ ধরনের কথা বলা—এগুলোকে আমরা রাজনীতির ভাষা মনে করি না। একটা রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতার ভাষা রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পড়া দরকার। তিনি যদি এমন ভাষা প্রয়োগ করেন, যেটা আসলে তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানায় না, তাহলে আমাদের জন্য হতাশার কারণ হবে।

প্রথম আলো:

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায়। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন নিয়ে আপনি কোনো শঙ্কা দেখেন?

গাজী আতাউর রহমান: নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না বিভিন্ন কারণে। একেক সময় রং একেক রকম হচ্ছে। সরকার যদি নির্বাচনের বিষয়ে আন্তরিক হয়, তাহলে নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই। নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে, সে জন্য ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের বেশি ঘনিষ্ঠ দল এনসিপি। সরকার তাদের অতিরিক্ত সুবিধা ও গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা নিজেদের জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান শক্তি মনে করছে। এনসিপির সঙ্গে মিট-আপ করাটা তো সরকারের দায়িত্ব।

প্রথম আলো:

বর্তমানে আইনশৃঙ্খলার যে ভঙ্গুর পরিস্থিতি, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কতটা সম্ভব বলে মনে করেন?

গাজী আতাউর রহমান: রোববারও নোয়াখালীতে মসজিদভিত্তিক একটা ধর্মীয় প্রোগ্রামে বিএনপি-ছাত্রদল আক্রমণ করল। সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটল। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রশাসনের তেমন কোনো ভূমিকা দেখিনি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি নিজেরা মারামারি-খুনোখুনি করছে। সে ক্ষেত্রেও আমরা প্রশাসনের দক্ষতা দেখছি না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমাদের বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পর তাঁরা পরিস্থিতি ঠিক করে ফেলবেন। কিন্তু তাঁরা আসলেই কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। কারণ, ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনও (ইসি) একটা পক্ষে ঝুঁকে গেছে। তারা এমন সব কথাবার্তা বলছে, এতে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে ইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করবে দূরের কথা, তারাই বরং মাঠটাকে একদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

প্রথম আলো:

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেছে। বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নেওয়া ও দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ চেয়েছে। জামায়াত বলেছে, প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। আর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ দিতে হলে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠীর অনুসারী উপদেষ্টাদের সবারই অপসারণ চেয়েছে এনসিপি। এ বিষয়গুলো আপনারা কীভাবে দেখেন?

গাজী আতাউর রহমান: উচ্চ আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর চূড়ান্ত রায় দিলে তত্ত্বাবধায়কের বিষয়টি পরিষ্কার হবে এবং এটা হয়তো পরবর্তী সরকারের জন্য। এখন হঠাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন রূপ দেওয়ার দাবিটা কেন, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। বিশেষ করে জুলাই সনদ এখনো আইনিভাবে কোনো দলিলে পরিণত হয়নি। এই মৌলিক কাজগুলো শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ দেওয়ার বিষয়টা তাদের ক্ষমতাকে খর্ব করার চিন্তা।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—এই তিন দলের পক্ষেই উপদেষ্টা পরিষদে কেউ না কেউ আছেন। এখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ করেন, তাহলে তো উপদেষ্টা পরিষদ থাকে না। অতএব এগুলো রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি। এসব না করে উপদেষ্টারা যাতে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন, সেটাই আমরা চাইব৷ তবে কোনো কোনো উপদেষ্টা সরকার থেকে বের হয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যদি এটা হয়, তা খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।

প্রথম আলো:

ইসলামপন্থী কিছু দল আগামী নির্বাচনে ইসলামের পক্ষে একটি ভোটবাক্স দেওয়ার পক্ষে তৎপর হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনাদের দলও আছে। এ বিষয়ে কত দূর অগ্রগতি হলো?

গাজী আতাউর রহমান: রোববার আমরা আটটি দল প্রথমবারের মতো যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছি। এটা তো অবশ্যই একটা অগ্রগতি। এখন আমাদের কনসার্নের জায়গা হলো একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন। নির্বাচনের যদি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে মানুষ এবার অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের বর্জন করার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ক্ষেত্রে নতুন শক্তি অবশ্যই, তারপর ইসলামি শক্তি—সেটা বিভক্ত না হোক, এটা আমরা চাইব। আটটি দলের বাইরে আরও দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমাদের দরজা খোলা থাকবে। এর পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা দেখতে হলে নির্বাচনের তফসিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।  

প্রথম আলো:

ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার এসে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কতটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

গাজী আতাউর রহমান: একাত্তরের পর বিগত ৫৪ বছরে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল, ভবিষ্যতে যদি তাদের মধ্যেই কেউ ক্ষমতায় আসে, তাহলে নতুন কিছু হবে না—এটা পরিষ্কার। মানুষ জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চাইলে নতুন কাউকে ক্ষমতায় আনতে হবে। জনগণ সে জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য মানুষ নতুন শক্তিকে ক্ষমতায় আনবে এবং আনা উচিত, এমন একটা ধারণা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে এর একটা আলামত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এর প্রতিফলন জাতীয় নির্বাচনে হবে বলে আমরা মনে করি।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

গাজী আতাউর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।