কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে—এই প্রশ্নে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছাড় দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই; বরং দল দুটি গত বুধবার ঢাকায় সমাবেশ করে তাদের চূড়ান্ত অবস্থান ঘোষণা করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধে তারা এখন মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। এই অবস্থায় সমঝোতা নিয়ে বিশ্লেষকদের সংশয় রয়ে গেছে।
সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে গেছে বিএনপি। তারা শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে অনড় থাকার কথা বলেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় আছে। দুই পক্ষ ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ অথবা পিছু না হটার অবস্থানে চলে গেছে কি না, এই প্রশ্নও সামনে এসেছে।
পয়েন্ট অব নো রিটার্নে কেউ চলে গেছে বলে আমি মনে করি না।
দুই দলই অবশ্য পিছু না হটার অবস্থানে চলে যাওয়ার বিষয়টি মানতে রাজি নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এ মুহূর্তে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যাওয়ার কথা বলা যাবে না। রাজনীতিতে এ কথা বলার সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও প্রায় একইভাবে পরিস্থিতিটাকে দেখছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে কেউ চলে গেছে বলে আমি মনে করি না।’
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার কোনো সুযোগ আছে কি না? যদিও লেখক ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস বাকি রয়েছে। এ মুহূর্তে দর-কষাকষির বিষয় বিবেচনায় রেখে দুই দলই পিছু না হটার অবস্থানে চলে গেছে। তবে তিনি এ–ও বলেন, দুই দলের যার যার অবস্থান থেকে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের আলোচনায় বসতে হতে পারে।
কিন্তু বিএনপি তাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপ শুরু করার কথা বলেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিতে হবে। এরপর তাঁরা ওই সরকার গঠনের বিষয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। তা না হলে তাঁরা রাজপথেই সমাধান খুঁজবেন।
দুই দলই এখন আলোচনার বিরোধিতা করছে না। কিন্তু আলোচনায় বসার প্রশ্নে দুই দল যার যার শর্তে অটল থাকার কথাই বলছে। তারা এখনো দল দুটি রাজপথে তাদের শক্তি দেখাতে ব্যস্ত রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থানে কোনো ছাড় না দেওয়ার কথা বলছে। দলটির নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের বাইরে তাঁরা যাবেন না। বিএনপিকে আগে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার ঘোষণা দিতে হবে। এরপর সংলাপ হতে পারে।
দুই দলই এখন আলোচনার বিরোধিতা করছে না। কিন্তু আলোচনায় বসার প্রশ্নে দুই দল যার যার শর্তে অটল থাকার কথাই বলছে। তারা এখনো দল দুটি রাজপথে তাদের শক্তি দেখাতে ব্যস্ত রয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা যখন ঢাকায় অবস্থান করছেন, এমন সময়ে বুধবারই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ঢাকায় অল্প দূরত্বে নিজ নিজ দলের সমাবেশ করে তাদের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছে। দুটি সমাবেশ থেকে তারা যার যার অবস্থানে অটল থাকারই ঘোষণা দিয়েছে।
তবে দুই দলের কাছেই এবারের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দুই দলের ক্ষমতার লড়াইয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট কাজ করছে। ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবারের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের কাছে একতরফা ছেড়ে দিতে চায় না। দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের দল বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। এবার তাঁদের আন্দোলনে মানুষের সমর্থন বেড়েছে এবং চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাঁরা যদি এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে না পারেন এবং আওয়ামী লীগ আবারও একতরফা নির্বাচন করার সুযোগ পায়, তাহলে তাঁদের দলকে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হতে পারে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের সংকটটা ভিন্ন রকম। দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা দলটি ক্ষমতার বাইরে গিয়ে প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে বা সংকটের মুখে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা তাদের মধ্যে রয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা শাসনে বিরোধী দল ও বিরোধী মত দমনের নানা অভিযোগ করে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল। ফলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দলটিকে এখন সব ধরনের উপায় খুঁজতে হচ্ছে।
ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই দুই পক্ষের মধ্যে যে ধরনের চিন্তা কাজ করছে, তাতে রাজপথে এক পক্ষের আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টাই এখনো দেখা যাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। গণ-আন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র আবার প্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকে মাত্র একবার—২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। এ ছাড়া অন্য সব নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অচলাবস্থা বা বিরোধ দেখা গেছে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে।
অতীতে এর আগে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে অন্তত তিনবার দুই প্রধান দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা কিংবা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দুবার হয়েছে বিদেশিদের মধ্যস্থতায়; কিন্তু সেসব আলোচনা বা সংলাপ সফল হয়নি।
এবারের নির্বাচন সামনে রেখেও বিদেশি কূটনীতিকদের দৃশ্যমান তৎপরতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বিধিনিষেধের কথা বলে নতুন ভিসা নীতি দিয়েছে।
এমন পটভূমিতে সংবাদমাধ্যমে অনেক সময় এমন খবরও প্রকাশিত হচ্ছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা অনেক বেশি, যা চোখে পড়ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য পরস্পরকে দায়ী করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বিদেশি কূটনীতিকদের চাপে দুই দল আলোচনা বা সংলাপে বসতে পারে। কিন্তু দুই পক্ষ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কোনো ছাড় দেবে কি না, সেই সন্দেহ তাঁদের রয়েছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো যদি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারে, তাহলে পরিস্থিতির ওপর রাজনীতিকেরা কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন, সে প্রশ্নেও আলোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদেরও অনেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে এমন আশঙ্কার কথা বলে থাকেন।
লেখক ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, দুই দলের কেউই এখনো ছাড় দিতে রাজি নয়। ফলে তারা নিজেরা কেউ আলোচনায় এগিয়ে আসবে, সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।