গণ অধিকার পরিষদ: বিভক্ত দুই পক্ষের আবার এক মঞ্চে আসার চেষ্টা

নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল কোটা আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদ। দুই পক্ষই বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে পৃথকভাবে অংশ নেয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেও পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। তবে এখন দুই পক্ষই বলছে, একত্র হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। আবারও সরকারি চাকরিতে কোটা–ব্যবস্থার বিষয়টি সমানে আসায় এই ইস্যুকে ঘিরে দুই পক্ষের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতা রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকের বিরোধে দলে ভাঙন দেখা দেয়। তবে গণ অধিকার পরিষদের দুই পক্ষের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখেও ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর দুই পক্ষ থেকেই একত্র হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। একাধিকবার আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে। কোটা–ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে উঠে আসা তরুণদের অংশ একত্র হতে আগ্রহী। তবে বিভিন্ন সময় দলে যোগ দেওয়া সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও পেশাজীবী অংশের অনীহা রয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গণ অধিকার পরিষদের দুই পক্ষই নিজেদের মতো করে কর্মসূচি দিচ্ছে। এর মধ্যে নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন অংশ দজনসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি দিচ্ছে। সম্প্রতি তারা আজিজ-বেনজীর, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে সিন্ডিকেট এবং ঈদের আগে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের মতো ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়েছে। অন্যদিকে গণ অধিকার পরিষদের অপর পক্ষ ‘ভারত বয়কট’ ইস্যুতে ধারাবাহিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যখন রাজনৈতিক দল গঠন করি, তখন নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো ছিল। ভাঙনের পরেও নিজেদের উপলব্ধি ছিল—যারা শুরু থেকে ছিলাম, তারা একসঙ্গে থাকলে জনগণের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাবে। দলে ভাঙনের পেছনে বিশেষ মহলের ইন্ধনও ছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখেই দ্বাদশ নির্বাচনের আগে-পরে নিজেদের মধ্যে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে পরিচিতি পাওয়া নুরুল হক ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নুরুল হক ও তাঁর সমমনা ব্যক্তিরা ২০২১ সালের অক্টোবরে গণ অধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলের আহ্বায়ক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রেজা কিবরিয়া।

গণ অধিকার পরিষদকে দল হিসিবে প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। দেশের কোনো দলে এত সমবয়সী নেতৃত্ব বিরল। পরে দল সম্প্রসারণ করতে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী ও পেশাজীবীদের টানা হয়। তাঁরা আহ্বায়ক কমিটিতে বিভিন্ন পদ পান।

গণবিক্ষোভ কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক
ফাইল ছবি

দল গঠনের দুই বছর হওয়ার আগেই শীর্ষ দুই নেতা রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকের বিরোধে ভাঙন দেখা দেয়। গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অব্যাহতি, অনাস্থা প্রস্তাব ও অপসারণের ঘটনা ঘটে। গত বছরের ১ জুলাই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে নুরুল হকের নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা আহ্বায়কের পদ থেকে রেজা কিবরিয়াকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন।

নুরুল হকের সমর্থকেরা গত বছরের ১০ জুলাই দলের জাতীয় কাউন্সিল করেন। তাতে নুরুল হক সভাপতি ও মুহাম্মদ রাশেদ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অপর পক্ষ এই কাউন্সিল মানেনি। বর্তমানে এই পক্ষের আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান আর ফারুক হাসান সদস্যসচিব। রেজা কিবরিয়া এই অংশের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। দলে ভাঙনের বছরখানেক হতে চললেও এই পক্ষটি পুরোপুরি দল গুছিয়ে উঠতে পারেননি।

দলের বিভেদে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হাতছাড়া হয়েছে নুরুল হকের অনুসারীদের। পুরানা পল্টনের প্রিতম-জামান টাওয়ারে দলের অস্থায়ী কার্যালয়টি বর্তমানে মশিউজ্জামান-ফারুক হাসানদের পক্ষ ব্যবহার করছে। নুরুল হকের অনুসারীরা বিজয়নগর এলাকার একটি ভবনে অস্থায়ী কার্যালয় করেছেন।

পৃথক কর্মসূচি, কোটায় কাছাকাছি আসা

গণ অধিকার পরিষদের দুই পক্ষই বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে দুই পক্ষই নিজেদের মতো করে কর্মসূচি দিয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরেও দুই পক্ষ আলাদা করে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে দুই পক্ষ আলাদাভাবে অংশ নেয়।

এ বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদের (মশিউজ্জামান-ফারুক) উচ্চতর পরিষদের সদস্য সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আমরা ইন্ডিয়া বয়কট ইস্যুতেই ধারাবাহিক আন্দোলন করছি। গণ অধিকার পরিষদের দুই পক্ষ একত্র হওয়ার চেষ্টা থেমে যায়নি। একাধিকবার আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে একসঙ্গে দেখা যেতে পারে।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করেছিল। কিন্তু ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই রায়ের পর  সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভ নতুন করে সামনে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে।

গণ অধিকার পরিষদের (মশিউজ্জামান-ফারুক) সমাবেশে সংগঠনের নেতারা
ফাইল ছবি

যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গণ অধিকার পরিষদের উত্থান, সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন হাসান আল মামুন। দলে ভাঙনের শুরুতে রেজা কিবরিয়া সদস্যসচিব ঘোষণা করেছিলেন হাসান আল মামুনকে। তবে তিনি নুরুল হক পক্ষের সম্মেলনে অংশ নেন। বর্তমানে এই পক্ষের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। হাসান আল মামুন শুরু থেকেই দলের ভাঙন ঠেকাতে সচেষ্ট ছিলেন।

এ বিষয়ে হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, পারস্পরিক বিভাজনগুলো মিটিয়ে দুই পক্ষের একসঙ্গে হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা হচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। নতুন করে কোটা নিয়ে যে বিক্ষোভ, সেটা আমাদের দূরত্বকে কমিয়ে দিতে পারে। ২০১৮ সালে যারা কোটা আন্দোলনে ছিল, তারা সবাই একসঙ্গে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারেও আলোচনা রয়েছে।

গণ অধিকার পরিষদের দুই পক্ষের নেতারা বলছেন, কোটা–ব্যবস্থা নিয়ে বিক্ষোভের অংশ হিসেবে দুই পক্ষের নেতারা ইতিমধ্যে একসঙ্গে আলোচনা করেছেন। ঈদের পরে কোনো কর্মসূচিতে দুই পক্ষকে একসঙ্গে দেখা যেতে পারে।