জরুরি অবস্থা ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে ঐকমত্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন প্রস্তাব বিএনপির
হাইলাইটস:
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির নতুন প্রস্তাব।
বিএনপির প্রস্তাবে জামায়াতের আপত্তি।
এ নিয়ে অন্যদের প্রস্তাব থাকলে দেওয়া যাবে আজ।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়া এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এ দুটি ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করে নতুন বিধান যুক্ত করা হবে।
গতকাল রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় এই দুই বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
জরুরি অবস্থা জারির বিধান নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে—মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করবেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা তাঁর অনুপস্থিতিতে উপনেতা অংশ নেবেন। কোন অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে, তা–ও নির্ধারণ করা হয়েছে। জরুরি অবস্থার মধ্যেও কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না বলে ঐকমত্য হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে—আপিল বিভাগের কর্মে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। তবে কোনো দল যদি নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করে যে জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তারা ক্ষমতায় গেলে সে অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করতে পারবে।
এ ছাড়া গতকাল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পাশাপাশি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদও একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এসব প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। অন্য কোনো দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে প্রস্তাব দিতে চাইলে আজ সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে কমিশনকে লিখিতভাবে জানাতে বলা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা চলছে। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিষয়ভিত্তিক এই আলোচনায় ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে। গতকাল ছিল আলোচনার দ্বাদশ দিন। এই পর্বে এখন পর্যন্ত আটটি বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে।
জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা যেভাবে
বিদ্যমান সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে সে ঘোষণার বৈধতার জন্য আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে, তারও উল্লেখ আছে।
এই বিধান পরিবর্তনের বিষয়ে এর আগের আলোচনায় ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু নতুন বিধানে কী কী থাকবে, তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব ছিল, মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করবেন। তবে জরুরি অবস্থায়ও কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না।
মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দলের আপত্তি ছিল। তাদের যুক্তি ছিল, মন্ত্রিসভা আর প্রধানমন্ত্রী একই বিষয়। এর পরিবর্তে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির পরামর্শে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করবেন, এমন প্রস্তাব করে জামায়াত ও এনসিপি।
গতকালের আলোচনার এক পর্যায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রস্তাব দেন—মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এনসিপি এই প্রস্তাব সমর্থন করে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন প্রস্তাব করেন, বিরোধীদলীয় নেতা অনুপস্থিত থাকলে উপনেতাকে যুক্ত করা হোক।
চূড়ান্তভাবে এই প্রস্তাবগুলো মিলিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায় দলগুলো। আলোচনা শেষে বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, সংবিধানের ১৪১(ক) অনুচ্ছেদে ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দের পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদন যুক্ত করা এবং বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তাঁর অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
এ ছাড়া জরুরি অবস্থা চলাকালে সংবিধানের ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদের বিধান সাপেক্ষে কোনো নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো খর্ব করা যাবে না বলে ঐকমত্য হয়েছে বলে আলী রীয়াজ জানান।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
আপিল বিভাগের কর্মে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন—এই প্রস্তাব ছিল বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের। তবে আগের কয়েক দফা আলোচনায় এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিভাজন ছিল। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল সরাসরি জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির পক্ষে ছিল। অন্যদিকে বিএনপিসহ কিছু দল ছিল জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করার পক্ষে।
গতকাল সকালে ও দুপুরে দুই দফা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, একাধিক বিকল্প রাখলে সমস্যা তৈরি হয়। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, বিকল্পে যাওয়া যাবে না। একজনেই থাকতে হবে।
একপর্যায়ে এবি পার্টির সানি আব্দুল হক একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। তা হলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। এই প্রস্তাব নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়।
একপর্যায়ে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ একটি নতুন প্রস্তাব দেন। তা হলো আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। যদি কোনো দলের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকে যে জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি করা হবে, সে দল নির্বাচনে জয়ী হলে তারা সেভাবে সংশোধন করতে পারবে।
জামায়াতে ইসলামী শুরুতে আপত্তি জানালেও পরে এই প্রস্তাবে একমত হয়।
পরে এ বিষয়ে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৫–এ সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন। অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তবে তারা সংবিধানে ‘আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতির মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান করবেন’—এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের অভিযোগের কারণে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীন কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকলে তাঁকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন প্রস্তাব
সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব করেছিল। তবে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এনসিসির প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়। ফলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার রূপরেখার সুপারিশও বাদ হয়ে যায়।
২ জুলাই ঐকমত্য কমিশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে সংবিধানে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান ছিল, তা এবং আরও দু-একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেদিন বিচার বিভাগ এবং রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে না রাখার বিষয়ে বেশির ভাগ দল মত দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে নতুন দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। গতকালের আলোচনায় ওই দুটির সমন্বয়ে একটি প্রস্তাব আনা হয়।
এটি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা প্রস্তাব করেন। তাতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পাঁচটি বিকল্প রাখা হয়েছে:
১. রাষ্ট্রপতি যত দূর সম্ভব সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবেন।
২. এভাবে নিয়োগ সম্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির সভাপতি হবেন রাষ্ট্রপতি। তবে তাঁর ভোটাধিকার থাকবে না।
৩. এভাবেও সম্ভব না হলে সংসদীয় ওই কমিটিতে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী তৃতীয় সর্বোচ্চ দলের একজন প্রতিনিধি নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভোটাধিকার থাকবে।
৪. এই কমিটির মাধ্যমেও সম্ভব না হলে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দলগুলোর মধ্যে (প্রধান বিরোধী দল ব্যতীত) যারা ন্যূনতম ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তাদের প্রতিটি দলের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি থাকবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভোটাধিকার থাকবে।
৫. এই ধাপগুলোতে একমত হওয়া না গেলে পঞ্চম বিকল্প হিসেবে ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে আসা যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে না রাখার বিষয়ে সব দল একমত হয়। তবে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে রাখা যায় কি না, বিবেচনা করা যেতে পারে।
সালাহউদ্দিন আহমদের প্রস্তাব লিখিতভাবে দলগুলোর প্রতিনিধিদের দেওয়া হয়। তবে এটি নিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আগের প্রস্তাবগুলোর কী হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। এর মধ্যে এই নতুন প্রস্তাব আনা হয়েছে। জামায়াতও প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সেটা এখানে আনা হয়নি।
বিএনপির প্রস্তাবের বিষয়ে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এ প্রস্তাবটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে ত্রুটি আছে। এ প্রস্তাবে আলোচনা করা যাচ্ছে না। জামায়াত অন্তত আলোচনায় অংশ নেবে না। তিনি বলেন, এ প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হবেন নিয়োগের কর্তৃপক্ষ। তাঁকে অনুসন্ধান কমিটির প্রধান করার কথা বলা হয়েছে। যিনি কর্তৃপক্ষ, তিনি আবার অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হন কীভাবে?
আলোচনার শেষ পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, অন্য কোনো দলের প্রস্তাব থাকলে তা আজ সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে কমিশনকে লিখিতভাবে দেওয়া যাবে।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।