বিশ্লেষণ: বিদায়ী দুই উপদেষ্টা সরকারে থেকে কেমন করলেন
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগের দিন পদত্যাগ করলেন ছাত্রদের প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টা। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
আসিফ মাহমুদ ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন থেকে সরকারে ছিলেন। তিনি স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
মাহফুজ আলম শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ছিলেন। নিয়োগ পান গত বছরের ২৮ আগস্ট। গত বছরের ১০ নভেম্বর তিনি উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। তবে সে সময় তাঁকে কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করার পর তাঁকে তথ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সবমিলিয়ে আসিফ মাহমুদ উপদেষ্টা ছিলেন ১৫ মাস। আর মাহফুজ আলম ছিলেন ১৩ মাস। এ সময়ে তাঁরা সরকারে থেকে কেমন করেছেন—সেই প্রশ্ন আসছে। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের পক্ষ থেকে ‘নতুন বন্দোবস্তের’ কথা বলা হয়েছিল।
মানুষ আশা করেছিল, গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বের জায়গা থেকে আসা উপদেষ্টারা অন্তত অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় কমাতে নতুন উদ্যোগ নেবেন। স্বজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকবেন। স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন।
বিদায়ী দুই উপদেষ্টা কেমন করলেন—জানতে চাওয়া হয়েছিল দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টার কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। সেই প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভূমিকা তাঁরা রাখতে পেরেছেন, তা বলা যাবে না; বরং তাঁদের মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং তাঁদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
দুই বিদায়ী উপদেষ্টাকে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁরা তখন পদত্যাগ না করে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণে নিমজ্জিত থাকলেন। এটি ভালো দৃষ্টান্ত হয়নি।
সবমিলিয়ে আসিফ মাহমুদ উপদেষ্টা ছিলেন ১৫ মাস। আর মাহফুজ আলম ছিলেন ১৩ মাস। এ সময়ে তাঁরা সরকারে থেকে কেমন করেছেন—সেই প্রশ্ন আসছে। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের পক্ষ থেকে ‘নতুন বন্দোবস্তের’ কথা বলা হয়েছিল।
আসিফ ভুঁইয়ার ১৫ মাস
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখনই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কর্মসূচি ছিল ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট, যা এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করা হয়। আর এ ঘোষণা আসে আসিফ মাহমুদের মাধ্যমে, যা শেখ হাসিনার সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আসিফ মাহমুদের ভূমিকা তাই স্মরণীয়। গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে শুরুতেই অন্তর্ভুক্ত হন আসিফ মাহমুদ। তিনি শুরুতে ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এ এফ হাসান আরিফকে (প্রয়াত) সরিয়ে আসিফ মাহমুদকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় গত বছরের নভেম্বরে। সেই থেকে তিনি স্থানীয় সরকার ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ হচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদকেরা। কারণ, বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে সব সময়ই এই মন্ত্রণালয় শীর্ষের দিকে থাকে। মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দলের নেতা–কর্মীদের সুবিধা দেওয়া হয়। এমনকি দলীয় তহবিল গঠনে এই মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয় বলেও অভিযোগ ছিল। হাসান আরিফকে সরিয়ে দেওয়া এবং আসিফ মাহমুদকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পেছনে এমন বিবেচনা ছিল বলে আলোচনা আছে এবং বিষয়টি নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল।
পদত্যাগের আগে আসিফ মাহমুদ গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন উন্নয়ন ও অর্জনের লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৩টি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ৩২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় ২১টি প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ১২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা বলে তিনি জানান। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এলজিইডির অর্জন হিসেবে উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা জানিয়েছেন তিনি। ডিপিএইচইয়ের অর্জন হিসেবে বিভিন্ন পানির উৎস, ড্রেন নির্মাণ, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক স্থাপনা উন্নয়নের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। ব্যয় সাশ্রয় হিসেবে ৩১টি প্রকল্প থেকে ২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা সাশ্রয়ের কথা বলেছেন। এ ছাড়া ই–রিকশার পাইলটিং কর্মসূচি, গাইবান্ধায় তিস্তা নদীর ওপর সেতু উদ্বোধন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিলের কথাও বলেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম ও সাফল্যের কথাও তুলে ধরেন আসিফ।
কিন্তু আসিফ মাহমুদের লিখিত ফিরিস্তির মধ্যে দুর্নীতি-অনিয়ম দমনে কী কী করেছেন, তা নেই। সচ্ছতা নিশ্চিতে, অপচয় দূর করতে, প্রকল্পের গুণগত মান ও কাজের মান বৃদ্ধিতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা নেই।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর বড় পদে নিয়োগে অনিয়ম, প্রকল্পে দুর্নীতি, প্রকল্পের গাড়ি জমা না দিয়ে ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ আগে ছিল। আসিফ মাহমুদের সময়েও এমন অভিযোগ উঠেছে। কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে আগের মতো ধারা।
আসিফ মাহমুদের লিখিত ফিরিস্তির মধ্যে দুর্নীতি-অনিয়ম দমনে কী কী করেছেন, তা নেই। সচ্ছতা নিশ্চিতে, অপচয় দূর করতে, প্রকল্পের গুণগত মান ও কাজের মান বৃদ্ধিতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা নেই।
যেমন বিদায়ী স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার জন্মস্থান কুমিল্লা। তাঁর সময়ে জেলাটির সড়ক ও অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামত ও উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ধরা হয় আসিফ মাহমুদের নিজ উপজেলা মুরাদনগরে (৪৫৩ কোটি টাকা)।
শুরুতে মুরাদনগরকেন্দ্রিক নানা রাজনৈতিক তৎপরতায় যুক্ত হন আসিফ মাহমুদ, তাঁর পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই এলাকা থেকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আলোচনায় আসে ঢাকা-১০ আসন (ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট এলাকা) থেকে তিনি নির্বাচন করবেন। মুরাদনগর থেকে ধানমন্ডি এলাকার ভোটার হওয়ার আবেদন করেন।
এর মধ্যে খবর বের হয় যে ঢাকার ২৭৪টি ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ উন্নয়ন বরাদ্দ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে মাত্র একটি বাদে অন্য ২৭৩টি প্রতিষ্ঠানই পড়েছে ঢাকার মাত্র তিনটি সংসদীয় আসন এলাকায়। ১৪৫টি মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দিরের অবস্থান ঢাকা-১০ আসনের অন্তর্ভুক্ত এলাকায়।
আসিফ মাহমুদের সময় বেশ কিছু বিতর্কিত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাঁর সময়ে জেলা পরিষদের মাধ্যমে ৪৪ উপজেলায় পাঠাগার করার প্রকল্প নেওয়া হয়। যদিও পাঠাগার করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। তারা কিছু জানতই না। ঢাকার ফুসফুস নামে পরিচিত ওসমানী উদ্যানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, যা নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি আছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৪৬ কোটি টাকা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ যেভাবে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ অপচয় করত, আসিফ ভুঁইয়ার সময়ে তেমন দুটি প্রকল্প নিয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। ব্যয় ৩৪৬ কোটি টাকা।
সরকারে গিয়ে আসিফ ভুঁইয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নেন। গত জুনে শাহজালাল বিমানবন্দরে তাঁর ব্যাগে একটি গুলি-ম্যাগাজিন পাওয়া গেলে বিতর্ক শুরু হয়। পরে তিনি বলেছিলেন, এটি অনিচ্ছাকৃতভাবে ব্যাগে চলে এসেছিল এবং ওই ম্যাগাজিন লাইসেন্স করা অস্ত্রের অংশ।
আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল হোসেনের নামে গত এপ্রিলে এলজিইডিতে ঠিকাদারি লাইসেন্স তালিকাভুক্ত করার খবর বের হয়। ছেলে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, বাবা ওই মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার ঠিকাদার হচ্ছেন—এমন খবরে সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ, এটি স্পষ্ট স্বার্থের সংঘাত।
পরে আসিফ মাহমুদ বলেন, স্থানীয় একজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার সুবিধার্থে বাবার পরিচয় ব্যবহার করার জন্য বাবাকে লাইসেন্স করার পরামর্শ দেন। বাবাও তাঁর কথায় জেলা নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার থেকে একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স করেন। তাঁর বাবা স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি বুঝতে পারেননি। সে জন্য বাবার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টানা ১৫ বছর পর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে তাকসিম এ খান দায়িত্ব পালন করেন। নানা সমালোচনা, অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তাঁর মেয়াদ বাড়িয়ে দায়িত্বে রেখে দেয় তৎকালীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এসে তাকসিমকে বিদায় করে। ওয়াসাতে এমডি নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ রয়েই গেছে।
গত ১১ নভেম্বর ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারীকে নতুন এমডি নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাঁকে নিয়োগ দিতে একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তির শর্ত। নিয়োগের যোগ্য করতে তাঁকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়। তারপর কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার ছাড়াই তিনজনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম উঠানো হয়, অর্থাৎ সমালোচনা, বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগও নিয়োগ আটকাতে পারেনি।
দেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিকেট বোর্ড গঠনে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে সরাসরি নিয়মবহির্ভূত হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। প্রথমে তিনি নিজের মতো করে জেলা ও বিভাগের কাউন্সিলর নিয়োগ করেন। ফলে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক নিয়োগ পুরোপুরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যাঁদের তিনি প্রয়োজন মনে করেছেন, তাঁরাই পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন।
উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকার সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আমার এলাকার একটি প্রকল্পের বিষয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে। আমরা জানি না তারা কিসের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন করেছে। প্রকল্পটি পাস হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিবেদন করা কতটা ঠিক হয়েছে। এ প্রকল্প একনেকে পাস হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আর একনেক সভা হবে না। তাই প্রকল্পটি আর পাস হবে না।’
নিজের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি দুদককে অনুরোধ করে জানিয়েছি, এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। যখন এ বিষয়ে অভিযোগ আসে, আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি কাউকে কিছু করার সুযোগ দিইনি। সে কারণে দুদককে অধিকতর তদন্তের জন্য অনুরোধ করি। এখন সেটি দুদকের এখতিয়ার। তারা হালনাগাদ তথ্য জানাতে পারবে।’
বিদায়ী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত এপ্রিলে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিজের এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেন আসিফ মাহমুদ। ফলে নিজের পছন্দের এপিএসের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনায় পড়েন উপদেষ্টা নিজেও।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোয়াজ্জেমের বিষয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেখানে কোনো অগ্রগতির খবর নেই।
মাহফুজ আলমের ১৩ মাস
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথমবার অংশ নিতে গিয়ে সফরসঙ্গী করেন মাহফুজ আলমকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টা, যা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
সমতা, নতুন বন্দোবস্ত আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন মাহফুজ আলম। তবে আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রক্রিয়ায় বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের (টিভি) লাইসেন্স দিত, সেই একই প্রক্রিয়ায় নতুন দুটি টিভির অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। লাইসেন্স দেওয়া হয় তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের।
মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি ঠিকমতো অফিসে আসতেন না। এলেও বিকেলের দিকে আসতেন। পদত্যাগ করার আগে অন্তত এক সপ্তাহ অফিসমুখী হননি।
আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রক্রিয়ায় বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের (টিভি) লাইসেন্স দিত, সেই একই প্রক্রিয়ায় নতুন দুটি টিভির অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। লাইসেন্স দেওয়া হয় তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের কিছুই হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রের সঠিক প্রচারসংখ্যা প্রকাশ, সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়ানো, সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা—এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি, এটা সত্য। উপদেষ্টা হিসেবে মাহফুজ আলমের এ বিষয়ে ভূমিকা নেওয়ার কথা। তবে তিনি সেটা নেননি, অথবা পারেননি। না পারার কী কারণ, সেটা তিনি ভালো জানবেন। তবে শোনা যায়, আমলারা তাঁকে সহযোগিতা করেননি। তিনি আমলাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
কামাল আহমেদ আরও বলেন, মাহফুজ আলম গত সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, তিনি অন্তত সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইনটি করে যাবেন। সেই অঙ্গীকারও তিনি রাখতে পারেননি। কেন পারেননি, সেটার ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারবেন।
মাহফুজ আলমের বড় ভাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনিসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলম। গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁকে করা হয় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পর্ষদ সদস্য। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে উপদেষ্টা ভাইয়ের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করেছেন এনসিপি থেকে বহিষ্কৃত মুনতাসির মাহমুদ। মুনতাসির গণ-অভ্যুত্থানের পর রেড ক্রিসেন্টে উপপরিচালক পদে চাকরি পেয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বিদায়ী দুই উপদেষ্টা সরকারে থেকে যে কাজ করেছেন, সেটা গতানুগতিক। বিশেষ কোনো অর্জন তাঁদের নেই।
গবেষক আলতাফ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হিসেবে দুই উপদেষ্টা সরকারে গেছেন। তাঁদের দায়িত্ব ছিল নিজের আওতাধীন ক্ষেত্রে সংস্কার এবং গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে প্রভাবিত করা। সেটা তাঁরা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।