ডাকসুতে ৫৪ বছরে নির্বাচন ৭ বার, এখন সামনে কয়েকটি প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৪ বছর আগে, ১৯২১ সালে। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম ভোট হয় ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে। সেই থেকে ১০০ বছরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ৩৭ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৪ বছরে নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র সাতবার।

বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং নানা ধরনের প্রকাশনা বের করার কাজই বেশি করেছে। ষাটের দশকেও এসব হয়েছে। তবে ষাটের দশকের শুরুতে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসুর ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক ভূমিকাই বড় হয়ে দেখা দেয়।

আরও পড়ুন

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্ররাজনীতিতে দলীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে নতুন করে গণতন্ত্রে ফেরার পর ডাকসুর নির্বাচনই বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় তিন দশক পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে এক দফা ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। তবে বিতর্কিত সেই নির্বাচনের পর ডাকসু ও হল সংসদ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সবাই যাতে প্রথম বর্ষে এসেই হলে সিট পান, গণরুম-গেস্টরুম যাতে আর ফিরে না আসে, ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে যেন সুলভ মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়, শিক্ষার পরিবেশটা যাতে ঠিক থাকে—এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন, এমন প্রতিনিধিই আমরা চাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সজীব
১ প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসুর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, ২ ডাকসু ও হল সংসদের প্রার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা, ৩ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের জিএস প্রার্থী আল সাদী ভুইয়া, ৪ শুভেচ্ছা বিনিময়ে শিবিরের প্রার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনে কয়েকটি বড় প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আবার দলীয় প্রভাবাধীন ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়বে, দলগুলো কি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দখলে চলে যাবে, শিক্ষার্থীদের কি আবার গণরুমে থাকবে হবে, জোর করে মিছিলে আনা হবে, আগের মতো নির্যাতন ও নিপীড়ন চলবে?

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা বলছেন, হল দখল ও নির্যাতনের সংস্কৃতি এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের একটি বড় ইস্যু বা বিষয়। যাঁরা এর বিরোধিতায় ছিলেন, তাঁদের ভোটে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছাত্রসংগঠনগুলোও এবার তুলনামূলক ভালো পরিচিত ও শিক্ষার্থী-অধিকারের পক্ষে সরব থাকা নেতাদের প্রার্থী করেছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছাত্রসংগঠনের বাইরেও শক্তিশালী প্যানেল ও প্রার্থী দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা চান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে দখল সংস্কৃতি, গণরুম, গেস্টরুম (অতিথিকক্ষে আদবকায়দা শেখানোর নামে নির্যাতন), জোর করে মিছিলে নেওয়ার প্রবণতা আর ফিরে না আসুক; বরং তাঁরা চান, ডাকসু ও হল সংসদ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলুক। ক্যাম্পাসে শান্তি, শৃঙ্খলা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকুক। আয়োজন করা হোক বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি আবার দলীয় প্রভাবাধীন ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়বে, দলগুলো কি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দখলে চলে যাবে, শিক্ষার্থীদের কি আবার গণরুমে থাকবে হবে, জোর করে মিছিলে আনা হবে, আগের মতো নির্যাতন ও নিপীড়ন চলবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ সজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই যাতে প্রথম বর্ষে এসেই হলে সিট পান, গণরুম-গেস্টরুম যাতে আর ফিরে না আসে, ক্যানটিন-ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে যেন সুলভ মূল্যে ভালো খাবার পাওয়া যায়, শিক্ষার পরিবেশটা যাতে ঠিক থাকে—এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন, এমন প্রতিনিধিই আমরা চাই।’ তিনি বলেন, নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে প্রার্থীদের নিজেদের সংগঠনের বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যাপার থাকবে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁদের আচরণে পরিবর্তন আসবে।

ডাকসুর ১০২ বছর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেন ডাকসু ও হল সংসদের নেতারা। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ডাকসু ছিল না। ২০১৯ সালে প্রথম আলোতে লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ (প্রয়াত) ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্র সংসদ হলো’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি জানান, ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরুর পর ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম হল ইউনিয়ন গঠিত হয়। কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকা হল ইউনিয়ন ও জগন্নাথ হল ইউনিয়ন এবং ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন’। ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র বদলে এর নামকরণ হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)’।

১৯৭০ সালে শুরু হয় সরাসরি ভোটব্যবস্থা। মানে হলো, শিক্ষার্থীদের ভোটেই ভিপি ও জিএসসহ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রার্থীদের নির্বাচিত করা শুরু হয়।

শুরুতে নির্বাচনের ব্যবস্থা একটু ভিন্ন ছিল। তখন হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। সেখানে ডাকসু প্রতিনিধিও নির্বাচিত হতেন। ডাকসু প্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হতেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি (সহসভাপতি) ও জিএস (সাধারণ সম্পাদক)। পর্যায়ক্রমে একেক বছর একেক হল থেকে ভিপি ও একেক হল থেকে জিএস নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম ছিল।

১৯৭০ সালে শুরু হয় সরাসরি ভোটব্যবস্থা। মানে হলো, শিক্ষার্থীদের ভোটেই ভিপি ও জিএসসহ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রার্থীদের নির্বাচিত করা শুরু হয়।

মোহাম্মদ হাননানের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০ থেকে ১৯৭১) বইয়ে তখনকার ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে ভিন্ন রীতি প্রচলিত ছিল। হল সংসদ নির্বাচনে পরিচিতি সভায় সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিতেন। এ রীতিকে বলা হতো ‘প্ল্যাটফর্ম প্রচার’। সাধারণত কেন্দ্রীয় সংসদের প্রার্থীরা বাংলায় বক্তব্য দিতেন। কিন্তু হল সংসদের প্রার্থীদের বেশির ভাগ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সবকিছুর ওপরই তাঁদের ব্যুৎপত্তি দেখাতে হতো।

আরও পড়ুন

ষাটের দশকে শক্তিশালী ছাত্রসংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ। মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, আইয়ুব খানও সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রদের মধ্যে একটি পেশাদার বাহিনী গঠন করেন। নাম দেন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এনএসএফ)। এই বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের প্রথম জনক হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করে।

বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের ভূমিকা ১৯৬৩ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভালো ফলে সহায়তা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মোহাম্মদ হাননানের বইয়ে। এতে আরও বলা হয়, তখন ১২৫টি পদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন একাই লাভ করে ৮০টি।

১৯৬৩ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে কোনো কোনো ছাত্রাবাসে এনএসএফের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেলে অংশগ্রহণ করে। তবে কেন্দ্রীয় সংসদ ডাকসুতে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী জয়লাভ করেন।

বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের ভূমিকা ১৯৬৩ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভালো ফলে সহায়তা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মোহাম্মদ হাননানের বইয়ে। এতে আরও বলা হয়, তখন ১২৫টি পদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন একাই লাভ করে ৮০টি।

সত্তরের নির্বাচনে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল সংসদের এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হলের কোটাভিত্তিক পদ্ধতিতে সর্বশেষ ডাকসুর ভিপি হয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ (আওয়ামী লীগ নেতা)। কিন্তু ১৯৭০ সালের পর থেকে ডাকসুতে সরাসরি ভোট হয়েছে। শুরু থেকেই ডাকসু ও হল সংসদ ছিল শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে একটা সংযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয় ডাকসু ও হল সংসদ দেখভাল করত, এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সহযোগিতা করত। পরে এটার রাজনীতিকীকরণ হয়ে যায়।

নিয়ম হলো, প্রতিবছর ডাকসুর নির্বাচন হবে। তবে তা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল সংসদ চালুর পর ব্রিটিশ আমলের ২৩ বছরে ভোট হয়েছে ১৪ বার। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে ভোট হয়েছে ১৬ বার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাকসুতে ভোট প্রথমে অনিয়মিত এবং একপর্যায়ে বন্ধই হয়ে যায়। এ সময়ে নির্বাচন হয়েছে সাতবার।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়নি যুদ্ধের কারণে। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুর ভিপি পদে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জিএস পদে মাহবুব জামান নির্বাচিত হন। তাঁরা দুজন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন।

১৯৭৩ সালে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হলেও ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। ওই বছর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বাঁধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই দুই ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেলের নাম দেওয়া হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী আ স ম আবদুর রব-সমর্থিত জাসদ ছাত্রলীগের অবস্থানও ছিল বেশ শক্ত। ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দিনভর নির্বিঘ্নে ভোট গ্রহণ হয়, সন্ধ্যায় ভোট গণনা শুরু হলে পাল্টে যায় দৃশ্যপট।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়নি যুদ্ধের কারণে। ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসুর ভিপি পদে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জিএস পদে মাহবুব জামান নির্বাচিত হন। তাঁরা দুজন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন।

পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক-এর খবরে বলা হয়, ডাকসু নির্বাচনে গোলাগুলি, হলগুলোতে ছিনতাই করা হয়েছে ব্যালট বাক্স। এ ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রবপন্থী জাসদ ছাত্রলীগ। স্থগিত হয় ভোট গণনা। বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন জোরপূর্বক ফলাফল ভন্ডুল করে দেয়।

১৯৭৯-৮০ থেকে ১৯৯০-৯১ পর্যন্ত পাঁচবার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হয়। এর মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না (জাসদ ছাত্রলীগ) দুবার, আখতারুজ্জামান (বাসদ ছাত্রলীগ) একবার, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ (ছাত্রলীগ) একবার ও আমান উল্লাহ আমান (ছাত্রদল) একবার ভিপি নির্বাচিত হন। জিএস পদে আখতারুজ্জামান দুবার এবং জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু (বাসদ ছাত্রলীগ), মুশতাক হোসেন (জাসদ ছাত্রলীগ) ও খায়রুল কবির খোকন (ছাত্রদল) একবার করে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

১৯৯১ সালের পর ২৮ বছর বন্ধ ছিল ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল হক (এখন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি) ভিপি ও ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ) গোলাম রাব্বানী জিএস হন।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ষাটের দশকের শেষের দিকে ছাত্র সংসদে দলীয় প্রভাব বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ছাত্রসংগঠনের নেতারা ছাত্র সংসদে যাওয়া শুরু করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর নেতা হতে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে।

আমরা নির্বাচিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করা হবে। ক্যানটিনে ফাউ খাওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক যে অপসংস্কৃতিগুলো ছিল, তা দূর করব
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এবার ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান

কেন নির্বাচন হয়নি

১৯৯১ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের দখলে ছিল। গত বছর পর্যন্ত পালা করে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকার সময় দল দুটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়নি এই আশঙ্কায় যে তাদের ছাত্রসংগঠনের (ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ) পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ক্যাম্পাস তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সব সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বড় ভূমিকা ছিল। দলগুলো তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চাইত না।

এই সময়জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালাক্রমে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ) হল নিয়ন্ত্রণ করেছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের গণরুমে রেখে জোর করে মিছিলে নেওয়া হতো, হলের গেস্টরুম বা অতিথিকক্ষে আদবকায়দা শেখানোর নামে নির্যাতন করা হতো, হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটত নিয়মিত। ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত ৭৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে ক্যাম্পাস ছিল ছাত্রলীগের দখলে। এ সময় নির্যাতনের মাত্রা অতীতকে ছাড়িয়ে যায়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার পর ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেন শিক্ষার্থীরা। এখন হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীর নাম দিয়ে কোনো কোনো সংগঠন তাদের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে হলের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অবশ্য ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও হলে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাওয়া যাবে এবং সেটাই কার্যকর ব্যবস্থা হবে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা। তাঁরা বলছেন, এ জন্য প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়া দরকার।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এবার ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করা হবে। ক্যানটিনে ফাউ খাওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক যে অপসংস্কৃতিগুলো ছিল, তা দূর করব।’

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

ডাকসুকে তার হারানো ‘গৌরবের জায়গায়’ ফিরিয়ে নিতে চান এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার।

উমামা ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় নেতৃত্ব দিয়েছে ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদ। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং স্বাধিকার আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা ঐতিহাসিক। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচিত হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করব। তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেব।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা। কার্জন হলের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

অন্যদিকে আবু বাকের মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের অধিকার, দেশের জনগণের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক করে তোলার ক্ষেত্রে ডাকসুর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। আমরা ডাকসুকে সেই পুরোনো গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাই।’

আমরা নির্বাচিত হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করব। তবে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানকেন্দ্রিক বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দেব।
স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা

ডাকসু নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

ডাকসু নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক, বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচন জাতীয়ভাবে অনেক বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন। সেটা সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানেও দেখা গেছে। এবারও ডাকসুতে কোন সংগঠন জিতবে, সেটা জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৫৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তিনি। সেই হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন সাত দশক ধরে। ৮৯ বছর বয়সী এই শিক্ষাবিদ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চাশের দশকে ডাকসু ও হল সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কাজগুলো করত। যেমন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা—এগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। ষাটের দশকেও এসব চর্চা হতো।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাটকের ক্ষেত্রে ডাকসুর অবদান অসামান্য। ছাত্র-শিক্ষক বিতর্ক, সাংবাদিক-শিল্পী বিতর্ক—এগুলো খুব উপভোগ্য ছিল। শিক্ষার্থীরা এগুলোতে খুব অংশ নিতেন। ডাকসু থেকে নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়েছে। তখন টিএসসি খুব মুখরিত থাকত। সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস খুবই প্রাণবন্ত ছিল। ডাকসু শুধু রাজনৈতিক নয়, নানা ক্ষেত্রে অনেক নেতৃত্ব তৈরি করেছে বলেও উল্লেখ করেন এই প্রবীণ অধ্যাপক। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখানে একটা অনুশীলনের জায়গা আছে। কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়াক্ষেত্রে এখানে একটা অনুশীলনের জায়গা আছে।

ডাকসুর কাজ কী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) পরিচালিত হয় এর গঠনতন্ত্র দিয়ে। ১৯৯১ সালের পর ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র তিনবার পরিবর্তন করা হয়।

সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি করা হয়। কমিটি ছাত্রসংগঠনসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে সুপারিশ জমা দেয়। এরপর গত ১৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটে গঠনতন্ত্রের সংশোধনী অনুমোদিত হয়।

সংশোধনীতে মূলত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বয়সসীমা তুলে দেওয়া হয়, যা ২০১৯ সালে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া তিনটি সম্পাদকীয় পদ যুক্ত করা হয়—মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক এবং ক্যারিয়ার বা পেশাজীবন উন্নয়ন সম্পাদক।

ডাকসু কী কাজ করবে, তা উল্লেখ রয়েছে গঠনতন্ত্রে। সেখানে উল্লেখিত ৯টি কাজ হলো—

১.     ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য সব সময় প্রচেষ্টা চালাবে ছাত্র সংসদ।

২.     ছাত্র সংসদ কমনরুম মেনটেইন (রক্ষণাবেক্ষণ) করবে এবং সদস্যদের ব্যবহারের জন্য অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া, দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী সরবরাহ করবে।

৩.    প্রতিবছর অন্তত একটি জার্নাল প্রকাশ। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত ও সভাপতির অনুমোদনে অন্যান্য বুলেটিন, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা প্রকাশ করা যাবে।

৪.     সময়ে সময়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাধারণের আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে বক্তৃতা আয়োজন এবং যখন সম্ভব সামাজিক সমাগম আয়োজন করা।

৫.     প্রতি বর্ষে ডাকসুর সদস্যদের মধ্যে বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এসব প্রতিযোগিতা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত থাকতে পারে।

৬.    সম্ভব হলে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠানো।

৭.     সপ্তম কাজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সম্মেলন ও অনুরূপ কর্মসূচিতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো বা প্রতিনিধি পাঠানো।

৮.     সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে উৎসাহ দেওয়া ও কল্যাণমূলক বক্তৃতা, প্রদর্শনী ইত্যাদির আয়োজন এবং সম্ভব হলে স্কুল মেনটেইনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদের সদস্যদের মধ্যে সেবার মনোভাব গড়ে তোলা।

৯.        সময়ে সময়ে নির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত ও সভাপতির অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাজ সম্পাদন করবে ডাকসু।